১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানের যুদ্ধে স্বাধীন বাংলার নবাব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হয়। ফলে প্রায় ২০০ বছরের জন্য বাংলা স্বাধীনতা হারায়। প্রতি বছর সে জন্য ২৩ জুন পলাশী দিবস হিসাবে পালিত হয়। ১৭৫৭ সালের এইদিনে নদিয়া জেলার পলাশীর প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভ, মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ চক্র এই কালো দিবসের জন্ম দেয়। এই যুদ্ধটি ইতিহাসের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ।
প্রাক কথন –
ঘৃণিত কলঙ্কজনক এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অধ্যায় সৃষ্টির পেছনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল বিশ্বাসঘাতক জগৎ শেঠ, মীরজাফর, মাহতাব চাঁদ, উমিচাঁদ বা আমির চন্দ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ, ঘসেটি বেগমের ক্ষমতার লোভ। রাজা রাজবল্লভ, মহারাজ নন্দকুমার, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, রানী ভবানী প্রমুখের কৌশলী চক্রও এর পেছনে প্রচ্ছন্ন ছিল। আজ পলাশী দিবসে ফিরে দেখা সেই ঘটনা – –
যুদ্ধক্ষেত্রে এই স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্রীদের শিকার ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিপাহসালার নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং তার বিশ্বস্ত সেনাপতি বকসী মীরমদন, প্রধান আমাত্য মোহনলাল কাশ্মিরী ও নবে সিং হাজারী।
বিবরণ –
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশী নামক স্থানে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাই পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত।
১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলী, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করে নি। ফলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারেন, তার সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল।
বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মীর জাফরকে বন্দি করার চিন্তা পরিত্যাগ করেন। তিনি মীর জাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বলেন। মীর জাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে নবাব রায় দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান, মীর জাফর, মীর মদন, মোহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করেন।
২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। ১৭৫৭ সালের ২২ জুন মধ্যরাতে রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা থেকে তার বাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষবাগ নামে আম্রকাননে এসে তাঁবু গাড়েন। বাগানটির উত্তর-পশ্চিম দিকে গঙ্গা নদী। এর উত্তর-পূর্ব দিকে দুই বর্গমাইলব্যাপী আম্রকানন। বেলা আটটার সময় হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করেন। তার প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। মীর মদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মীর জাফর, ইয়ার লুৎফ খান ও রায় দুর্লভ যেখানে সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মীর মদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজউদ্দৌলার গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মীর মদন এবং অপর সেনাপতি মোহন লাল ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মীর মদন মারাত্মকভাবে আহত হন ও মারা যান। নবে সিং হাজারী ও বাহাদুর খান প্রমুখ গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধানও একইসাথে মৃত্যুবরণ করেন।
গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান নিহত হওয়ার পর সিরাজউদ্দৌলা মীর জাফর ও রায় দুর্লভকে তাদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তীব্র বেগে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু উভয় সেনাপতি তার নির্দেশ অমান্য করেন। তাদের যুক্তি ছিল গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া অগ্রসর হওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার। কিন্তু কোম্পানি ও নবাবের বাহিনীর মধ্যে তখন দূরত্ব মাত্র কয়েকশত গজ। বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহন লাল নবাবকে পরামর্শ দেন যুদ্ধবিরতি ঘটলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী কিন্তু সিরাজ মীর জাফর প্রমুখের পরামর্শে পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেন। বিকেল পাঁচটায় সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী নির্দেশনার অভাবে এবং ইংরেজ বাহিনীর গোলন্দাজি অগ্রসরতার মুখে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে অর্থাৎ পরাজয় স্বীকার করে। নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে আসে। ইংরেজদের পক্ষে ৭ জন ইউরোপীয় এবং ১৬ জন দেশীয় সৈন্য নিহত হয়। তখন কোনো উপায় না দেখে সিরাজউদ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য ২,০০০ সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যেও কেউ তাকে সাহায্য করেনি। সিরাজউদ্দৌলা তার সহধর্মিণী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক অভিমুখে যাত্রা করেন। তার আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সেনাপতি মসিয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রাজা রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু তার সে আশা পূর্ণ হয়নি। সিরাজ পথিমধ্যে বন্দি হন ও মিরনের হাতে বন্দি অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে।
ষড়যন্ত্রকারীদের হাল –
ষড়যন্ত্রকারীরা কেউই সুখে ছিলেন না। ক্লাইভ আত্মহত্যা করলেন, উমিচাঁদ হলেন পাগল, নিদারুণ কুষ্ঠরোগের যন্ত্রণা ভুগে শেষ পর্যন্ত কিরীটেশ্বরীর চরণামৃতপানে একজনের প্রাণ যায়, একজন মারা গেলেন বজ্রাঘাতে। আর শেঠ-ভ্রাতৃদ্বয়কে বুকে পাষাণ চাপা দিয়ে মুঙ্গের দুর্গের চূড়া থেকে গঙ্গায় ফেলে ডুবিয়ে মারা হয়।
https://slotbet.online/