সনাতন ধর্মে কেন মৃতদেহ পোড়ানো হয় ⁉️
জন্মিলে মরিতে হইবে, অমর কে কোথা কবে? যে জীব জন্মলাভ করেছে, সে মৃত্যুবরণ করবে। ইহা আমাদের জীবনের অনস্বীকার্য সত্য। শাস্ত্রে তা সর্বৈব স্পষ্ট,
“জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।”
– গীতা ২/২৭
অর্থাৎ, যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু নিশ্চিত, এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্মও নিশ্চিত। অতএব এ অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয়।
তবে মৃত্যু কখনো জীবাত্মার হয় নাহ, বরং নশ্বর দেহ উপযোগী থাকে নাহ তখন জীবাত্মা এই দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহধারণ করে। কারণ, আত্মা অনাদি সত্তা।
কিন্তু মৃত্যুবরণ করলে প্রতিটি প্রাণীকে তার এই নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করতে হয়। কারণ জীবাত্মা অনাদি সত্তা, কিন্তু এই দেহ নশ্বর ও প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যাবে প্রকৃতির নিয়মে। তবে এই জীব জগতে অন্যান্য প্রাণী মৃত্যুবরণ করলে যেভাবে মৃতদেহ প্রকৃতিতে নিঃশেষ হতে থাকে, মনুষ্যদেহ সেভাবে হয় নাহ। বরং, মনুষ্য দেহ মৃত্যুর পরে তাহার শেষকৃত্য ভিন্ন ও উত্তম উপায়ে সৎকার হয়ে থাকে।
মনুষ্য জন্মলাভ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ষোড়শ সংস্কার পালন করে থাকে। অন্তেষ্টিক্রিয়া সেই ষোড়শ সংস্কারের সমাপ্তি করে থাকে। কিন্তু অন্তেষ্টিক্রিয়া কিংবা শেষকৃত্য নিয়ে লোকসমাজে রয়েছে বৈচিত্র্যতা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা ভৌগোলিক পরিমন্ডলে যেখানে মৃতদেহ দাফন কিংবা সমাধি দেওয়ার প্রচলন রয়েছে, তেমনি সনাতনী, শিখ, বৌদ্ধ ও জৈন সংস্কৃতিতে মৃতদেহ দাহ বা পোড়ানো হয়ে থাকে। এছাড়াও জরথুস্ত্রীয় বা পার্সিদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর পর সেই মৃতদেহ প্রকৃতি উদ্দেশ্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে দান করা হয়ে থাকে। যেখানে শকুন, পিঁপড়া কিংবা পোকামাকড় সে দেহকে ধীরে ধীরে বিলীন করে ফেলে। আমরা প্রতিটি অন্তেষ্টিক্রিয়া বা শেষকৃত্যের পথকে সম্মান প্রদর্শন করি। কারণ, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক কারণে এমন বৈচিত্র্যতা।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, কতিপয় অজ্ঞানী ব্যক্তি সনাতনীদের সুপ্রাচীন অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু সংশয় উত্থাপন করেছে। কিন্তু সে দাবি বর্তমান সময়ে এসে সনাতনীদেরও দ্বিধান্বিত করে তুলছে। কারণ, সে ব্যক্তিগণ তাদের যুক্তিতর্ক দ্বারা অন্তেষ্টিক্রিয়ায় মৃতদেহ দাহ করাকে অমানবিক ও নিষ্ঠুর ও অযৌক্তিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ফলস্বরূপ, বর্তমানে এমন অপদাবি খণ্ডন করে সত্য ও যুক্তিসিদ্ধ করা কর্তব্য হয়ে গিয়েছে।
সনাতন ধর্মশাস্ত্রে আত্মার নিত্যতা ও দেহকে নশ্বর উল্লেখ করা হয়েছে। মনুষ্য দেহ নশ্বর সেজন্য, এই দেহ যখন জীবাত্মা পরিত্যাগ করে তখন তাহা অকার্যকর হয়ে পড়ে। সেজন্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে,
“ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে”।। =[]গীতা: ২/২০[]=
অর্থাৎ, আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না। তিনি জন্মরহিতশাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।
সেজন্য জীবাত্মা শুধু পুরাতন জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে। এরুপ বাক্য শ্রীমদ্ভগবদগীতার ২য় অধ্যায়ের সাংখ্যযোগ এর ২২তম শ্লোকে উল্লেখ রয়েছে,
“বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি ।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য- ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী” ॥ =[]গীতা: ২/২২[]=
অর্থাৎ, মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে , দেহীও তেমনই দেহত্যাগ করে নতুন দেহধারণ করে ।
“নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ”।।২৩
“অচ্ছেদ্যেহয়মদাহ্নোহয়মক্লোদ্যোহশোষ্য এব চ।
নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ।
অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে”।।২৪
=[] গীতা: ২/২৩-২৪[]=
অর্থাৎ, শস্ত্র সকল ইহাকে ছেদন করিতে পারে না, অগ্নিতে দহন করিতে পারে না, জলে ভিজাইতে পারে না। এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেশ্য, অশোষ্য। ইনি নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির, অচল, সনাতন, অব্যক্ত, অচিন্ত্য অবিকার্য বলিয়া কথিত হন।
জীবাত্মা অবিনাশী সত্তা হওয়ায় মোক্ষ অর্জনের জন্য বারংবার এই জগতে ফিরে আসতে হয় এবং বিবিধ যোনিতে তাহার পুনর্জন্ম হয়ে থাকে। জীবাত্মা যেন তাহার কর্মফল ভোগ করে পুনঃ নিজেকে এই জন্ম মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত করে মোক্ষ অর্জনে সক্ষম হতে পারে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে ইহা স্পষ্ট যে, জীবাত্মা এই দেহের অংশ নয় এবং জীবাত্মা অনাদি এবং দেহ নশ্বর। সে নশ্বর দেহ জীবাত্মা যখন ত্যাগ করে, তখন এই দেহের মধ্যে থাকা অনুভূতি, চেতনা কিছু বিদ্যমান থাকে নাহ। কোনো ইন্দ্রিয়,কোনো শক্তি কিংবা কোনো চেতনা বিদ্যমান না থাকাতে ইহা অকার্যকর হিসেবে পরিণত হয়। সেজন্য, মনুষ্য সমাজ শেষকৃত্যের মাধ্যমে সে নশ্বর দেহের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে থাকে।
শাস্ত্রে দাহের বিধান:
অন্ত + ইষ্টি = অন্ত্যেষ্টি “অন্ত” মানে শেষ ; “ইষ্টি” মানে যজ্ঞ বা শুভ কর্ম
অর্থাৎ “অন্ত্যেষ্টি” হলো জীবনের “শেষ যজ্ঞ” । মানব জীবনের ষোড়শ সংস্কারের মধ্যে অন্তিম সংস্কার হল অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া ।সনাতন ধর্মের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি স্বয়ং বেদ। বেদেই মৃতদেহ দাহ করার বিধান উল্লেখ রয়েছে। যা যজুর্বেদ এর ৪০ তম অধ্যায় এর ১৫তম মন্ত্রে স্পষ্ট,
“বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম্।
ও৩ম্ ক্রতো স্মর ক্লিবে স্মর কৃতং স্মর”।।
-যজুর্বেদ ৪০/১৫
অনুবাদঃ- হে কর্মশীল জীব! শরীর ত্যাগের সময় পরমাত্মার নাম “ও৩ম্” স্মরণ করো।আধ্যাত্মিক প্রাণ, আধিদৈবিক প্রাণ এবং পুনরায় সেই প্রাণস্বরূপ পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হও। তৎপর এই ভৌতিক শরীর ভস্মে পরিণত হউক।
এছাড়াও ঈশোপনিষদ ১৭, ঋগ্বেদ ১০/১৫/১৪, ১০/১৬/১, পারস্কর গৃহ্য সুত্র ৩/১০/৫ সুত্র মনুঃ৫/৬৮-৬৯, কাত্যায়ন সংহিতা ২১/৯-১২ সহ বহু শাস্ত্রে দাহের উল্লেখ আছে।
মৃতদেহ পোড়ানোর কারণ:
এই প্রকৃতি পঞ্চভূত এর সমন্বয়ে গঠিত। আমাদের জীবদেহ তেমনি পঞ্চভূত এর সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে। জীব মৃত্যুবরণ করলে প্রকৃতির নিয়মে তা পুনরায় প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু মনুষ্য দেহ অন্যান্য প্রাণীর মতো ফেলে রাখা যায় নাহ। এটা যেমন অস্বাস্থ্য ও বিপজ্জনক, তেমনি অসম্মানজনক। সেজন্য মৃতদেহ বৈদিক নিয়মবিধি অনুসরণ করে কাষ্ঠদ্বারা ভস্মীভূত করা হয়ে থাকে। কিন্তু উল্লেখ্য যে সনাতনীদের শুধু দাহ নয় বরং সমাধি ও জলে ভাসিয়ে দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। তবে দাহ ও সমাধি অধিক প্রচলিত। সমাধি দ্বারাও পঞ্চভূতে বিলীন হয় তবে সময় ও পরোক্ষভাবে। নাথ ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনুসারীগণ সমাধির মাধ্যমে শেষকৃত্য করেন। অর্থাৎ সনাতন ধর্মে সমাধিও গ্রহণযোগ্য কিন্তু মৃতদেহ দাহকে অধিক মান্যতা ও উত্তম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
মৃতদেহ দাহ করা কি মৃতদেহের প্রতি অসম্মান বা অমানবিক ?
উদ্ভট সব যুক্তিতর্কের সন্ধান পাওয়া যায়। মৃতদেহ কাকে বলা হয়? কোনো জীবিত ব্যক্তির দেহকে কখনো লাশ বা মৃতদেহ বলা হয়? অবশ্যই নাহ! যখন কেউ মারা যায়। তখনই তার আত্মাহীন দেহকে মৃতদেহ বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আপনার বাবা যখন মারা যায় তখন আপনি সে আত্মাহীন দেহকে বাবা সম্বোধন না করে বাবার লাশ বা মৃতদেহ বলে সম্বোধন করছেন। তাহলে কি আপনি আপনার বাবাকে অসম্মান করছেন? যদি না হয়ে থাকে, তবে সে চেতনাহীন মৃতদেহকে সঠিক ধর্মাচরণ দ্বারা, বৈদিক শাস্ত্র পদ্ধতি অনুসরণ করে দাহ করলে অসম্মান কেন হবে? মনুষ্য দেহ দাহ করা অমানবিক এমন যুক্তিও অসার। মনুষ্যত্ব যে ধর্মশাস্ত্রের প্রধান বাক্য৷ সে ধর্মের অনুশাসনকে আপনি মনুষ্যত্বের উপদেশ দেওয়া নিতান্তই অযৌক্তিক। মনুষ্যত্ব এবং মানবিকতা আপনি সে জীবিত মানুষ এবং প্রাণীদের প্রতি প্রদর্শন করা আবশ্যক। ইহাই মনুষ্যত্বের সঠিক শিক্ষা। মৃতদেহের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে তার সৎকার করা উচিত এবং বৈদিক শাস্ত্র পদ্ধতি অনুসরণ করে সে কাজটি সুনিপুণ ও সম্মানের সহিত করা হয়।
মৃতদেহ দাহের উপকারিতা ও যৌক্তিকতা:
মৃতদাহ কিংবা সমাধি উভয় প্রকারে রোগ-জীবাণু ছড়ানো থেকে প্রতিরোধ করে। কিন্তু মৃতদাহ করার মাধ্যমে সে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট হয়। এছাড়াও স্থান সংকট মৃতদেহ সমাধির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। করোনার সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একাধিক সমাধির স্থান সংকট প্রবল হয়ে উঠে। ফলে একটির উপর আরেকটি সমাধি দেওয়ার দৃষ্টান্ত অহরহ। যারা মৃতদেহের অসম্মান এর কথা বলে দাহকে কটাক্ষ করেন তাদের নিকট এই কাজটি কি কখনো অসম্মানজনক মনে হয়েছে? যদি না হয় তবে মৃতদেহ দাহ করাকে ভবিষ্যতে অসম্মানজনক কিংবা অমানবিক এমন যুক্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
পরিশেষে এতটুকু বলার রয়েছে, মৃতদেহ দাহ কিংবা সমাধি নাহয় অন্য কোনো সংস্কৃতিতে অন্য কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকলে সেটা সর্বদা সম্মান প্রদর্শন করা শ্রেয়। আমরা সনাতনীরা কখনো অপরের সৎকার পদ্ধতিকে কখনো কটাক্ষ কিংবা অযৌক্তিক প্রমাণ করতে যাইনি। কারণ, আমরা পৃথিবীর প্রতিটি মত-পথকে সম্মান প্রদর্শন করার যে গুণ “পরমতসহিষ্ণুতা” তাকে ধারণ করি।
https://slotbet.online/