• অন্যান্য
নোটিফিকেশন
আজকের সর্বশেষ সবখবর

যখন আমার স্বামী বেঁচে ছিলেন আমি ছিলাম এই ঘরের রানী

ESARA NEWS
মে ১২, ২০২৫ ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ । ২ জন
Link Copied!

যখন আমার স্বামী বেঁচে ছিলেন, তখন আমি ছিলাম এই ঘরের রানী। তাঁর মৃত্যুর পর যেন আমার গোটা জীবনটাই পালটে গেল। — এতটুকু বলেই অশ্রুধারায় ভেসে গেলেন বুড়ি মা।

আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। তখন আমার স্বামী জীবিত ছিলেন। আমরা দু’জন এবং আমাদের সন্তানরা গ্রামেরই এক ছোট্ট বাড়িতে থাকতাম। স্বামীর সামান্য একটু জমি ছিল, সেখানেই তিনি চাষাবাদ করতেন। ওই জমির ফসলেই আমাদের সংসার চলত, কারণ চাষ ছাড়া আর কোনও আয়ের উৎস ছিল না।

জীবন বেশ ভালোই চলছিল। হঠাৎ করেই কয়েক মাস পর গ্রামে খরার প্রকোপ দেখা দিল। ফলে চাষাবাদ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল ওই জমিটাই। কোনওরকমে কয়েকটা মাস কষ্ট করে কাটানো গেল। কিন্তু এরপর কী হবে, তা ভেবেই স্বামী শহরে গিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

শহরে গিয়ে উনি বোঝা টানার কাজ করতে লাগলেন। কিছুদিন পর গ্রামের পরিস্থিতি একটু ভালো হলেও, উনি শহরের কাজ চালিয়ে গেলেন। এভাবেই একটানা সাত বছর পার হয়ে গেল। ততদিনে আমাদের সন্তানরাও বড় হয়ে গেছে এবং তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। তবুও আমার স্বামী কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। উনার বিশ্বাস ছিল, শরীর চলতে থাকলে কাজ করা উচিত—নইলে শরীরই একদিন রোগ-ব্যাধির বাসস্থান হয়ে যায়।

আমাদের বড় ছেলের নাম বিশাল, সে গ্রামেই ফার্নিচারের কাজ করে। মাঝের ছেলে দীপক শহরে মেকানিকের কাজ করে, আর ছোট ছেলে গ্রামের মধ্যেই একটা মুদির দোকান চালায়।

আমরা দুজনে ঠিক করলাম, এখন তো ছেলেরা নিজেদের মতো দাঁড়িয়ে গেছে, এবার তাদের বিয়ে দেওয়া উচিত। একে একে তিনজনের বিয়েই দিয়ে দিলাম। বিয়ের পর তারা নিজেদের সংসার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

একদিন হঠাৎ শহর থেকে ফোন এল — “শিবা জির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আপনি শহরে এসে দেহটি নিয়ে যান।” — পুলিশ ফোনে বলল। খবরটা শুনেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। পরে বড় ছেলে শহরে গিয়ে বাবার মৃতদেহ নিয়ে আসে এবং শেষকৃত্য করে।

স্বামীর মৃত্যুর কয়েকদিন পর থেকেই ছেলেরা এবং তাদের স্ত্রীরা আমার সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে। যে বউমা একসময় আমার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথাও বলত না, সে আজ বলছে — “এই বাড়িতে থাকতে হলে কাজ করতে হবে, নাহলে বাড়ি থেকে বের করে দেব!”

আমি যখন এই কথা ছেলেদের বললাম, তারা একটাও কথা না বলে চলে গেল। এরপর বউমারা আমার ঘরটিও কেড়ে নেয়। বলে, “এখন থেকে তুমি বাড়ির বাইরে থাকা ওই ঝুপড়িতেই থাকবে।” — এই বলে চলে যায়।

মাথা নিচু করে, কাঁপা কাঁপা হাতে, অশ্রুসজল চোখে আমি সেই ঝুপড়িতে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে রইতে শুরু করলাম। গোটা জীবনটাই বদলে গেল। যাদের জন্য এত বছর কষ্ট করলাম, সেই সন্তানরাই আজ পর হয়ে গেছে।

এখন আমার দিন কাটে কখনও মাঠে গিয়ে একটু কাজ করে, কখনও বা গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে বসে সময় কাটিয়ে, আর মাঝেমধ্যে মন্দিরে গিয়েও থাকি। সন্ধ্যা হলেই সেই অন্ধকার ঝুপড়ির দিকে ফিরে আসি, যেখানে অপেক্ষা করে শুধু নিঃসঙ্গতা আর নির্জনতা।

গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক মানুষ আর কিছু নারী আমার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের অবস্থাও তেমন ভালো নয়, সাহায্য করার মতো সামর্থ্য তাদের নেই।

একদিন গ্রামের শিব মন্দিরে বড় ভোজের আয়োজন হয়। আমিও গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে আমার জন্য কোনও জায়গা ছিল না। কেউ আমাকে একটুকরো প্রসাদও দিল না। সেদিন যেন আমার হৃদয়টা একেবারে ভেঙে গেল।

শেষমেশ আমি সিদ্ধান্ত নিলাম—আর না। আমি আর কারও উপর নির্ভর করব না। আমার ঝুপড়ির পিছনে একটু খালি জায়গা ছিল, সেখানে আমি নিজেই সবজি ফলাতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে নিজের জন্য নিজেই কাজ করতে লাগলাম। গ্রামের কয়েকজন ভালো মানুষও এগিয়ে এল।

উপসংহার:
বুড়ি মার জীবনের এই কাহিনি আমাদের শেখায়—জীবনে যত কষ্টই আসুক, হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। নিজের আত্মসম্মান আর আত্মনির্ভরতার মাধ্যমে আবারও নতুন করে শুরু করা যায়। যখন নিজেররাও পর হয়ে যায়, তখন একমাত্র নিজের মনের জোর আর পরিশ্রমই পারে আপনাকে রক্ষা করতে।

যদি গল্পটি ভালো লেগে থাকে তাহলে Like, Share এবং Follow করুন। আপনার মতামত কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না।