আমার মা কখনো বাড়ির পুরুষদের সাথে খান নি। পুরুষদের খাওয়া হয়ে গেলে তারপর তিনি খেতেন।
আমি তখন ছোটো। বয়স বোধহয় সাত কি আট হবে। একদিন দুপুরের খাওয়ার পর খেলতে খেলতে রান্নাঘরে এলাম। মা তখন খাচ্ছিলেন। মায়ের প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ভাত আর কিছু সবজি দিয়ে মা খাচ্ছেন। ঐ ছোট্ট বয়সে মাথায় এলো না, দুপুরে বাড়ির সবাই ডিম, মাংস দিয়ে ভাত খেলাম। কিন্তু মা কেনো সামান্য সবজি দিয়ে ভাত খাচ্ছেন?
পরবর্তীতে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে অপুষ্টির কারণে মা মা’রা যান।
আমার বড়ো বোন যতোদিন বাবার বাড়িতে ছিলেন তিনিও বাড়ির পুরুষদের খাওয়ার পর মায়ের সাথে খেতেন। মায়ের মতো তারও পুষ্টিকর খাবার জুটতো না। ফলে দুর্বল শরীর নিয়ে তিনিও বেড়ে উঠতে লাগলেন।
মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে আপার বিয়ে হয়। মা এবং আপা বিয়েতে রাজি ছিলেন না। বাবা জোর করে আপার বিয়ে দেন। বছর না ঘুরতেই আপার পেটে সন্তান এলো। মেয়ে বলে এমনিতে পুষ্টিকর খাবার খেতে পেতেন না। আর পেটে সন্তান আসার পর তাকে আরো কম খেতে দেয়া হতো।
তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বলতো,”ওকে কম খেতে দেবে। কারণ বেশি খেলে পেটের বাচ্চা বড়ো হয়ে যাবে। তখন নরমাল ডেলিভারি হবে না। তখন সিজার করতে হবে। এতে খরচ বেশি হবে।”
মৃগেল মাছ, বোয়াল মাছ, শিং মাছ, শোল মাছ, শসা, কলা এগুলো আপাকে খেতে দেয়া হতো না। কারণ তারা বলতো, মৃগেল মাছ খেলে সন্তানের মৃ’গী রোগ হবে। বোয়াল মাছ খেলে সন্তানের চোয়াল বড়ো হবে। শিং কিংবা শোল মাছ খেলে সন্তান সা’পের মতো হবে। শসা খেলে সন্তানের চামড়া ফাটা ফাটা হবে। কলা খেলে ঠান্ডা লাগবে। আর চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণের সময় আপাকে সারাদিন না খাইয়ে রাখা হতো। বলতো ঐ সময় খেলে সন্তানের অমঙ্গল হবে।
অর্থাৎ প্রয়োজনীয় খাবার না পেয়ে আমার অপুষ্ট আপা আরো দুর্বল হয়ে পড়লেন। পরে তিনি যে সন্তান জন্ম দিলেন তা ছিলো খুবই কম ওজনের। এবং অসুস্থ। মাস তিনেক পরই সন্তানটি মা’রা গেলো। অথচ সন্তান মৃ’ত্যুর জন্য আপাকেই দায়ী করা হলো। বলতো, আপা ঠিক ভাবে সন্তান পালন করতে পারেন নি তাই সন্তান মা’রা গেছে।
এদিকে অল্প বয়সে মা হয়ে আপার অসুস্থ শরীর পুরোপুরি ভেঙে পড়লো। ঐ অসুস্থ শরীরে পরের বছর আপা আবারো গর্ভবতী হলেন। তারপর একই ভাবে নরমাল ডেলিভারির জন্য আপাকে কম খাইয়ে রাখা হতো। পরের সন্তানটি জন্ম দেয়ার ধকল আপার অসুস্থ শরীর নিতে পারে নি। একটা অপুষ্ট শিশু জন্ম দিয়ে আপা মা’রা গেলেন। আপার মৃ’ত্যুতে মা খুব আঘাত পেয়েছিলেন। কেননা, আপার মৃ’ত্যুর মূল কারণটা তিনি সবচেয়ে ভালো উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
পরে আমি যখন বিয়ে করলাম। এবং যখন দেখলাম যে, বাড়ির পুরুষদের খাওয়ানোর পর আমার স্ত্রী আলাদা ভাবে খাচ্ছে, তখন আঁতকে উঠলাম।
একদিন টেবিলে খাবার দিয়ে সে যখন চলে যাচ্ছিলো, আমি তখন তাকে বললাম,”তুমি আমাদের সাথে খাবে।”
কথাটা শুনে সে চমকে উঠলো। এবং আমার বাবাও চমকে উঠলেন।
বাবা আমাকে বললেন,”জীবনে কখনো দেখেছিস বাড়ির মেয়েরা পুরুষদের সাথে খায়?”
বললাম,”এতোদিন খায় নি, কিন্তু এখন থেকে খাবে।”
“এটা বেয়া’দবি।”
কিছুটা রে’গে গিয়ে বললাম,”আমার মা আপা দিনের পর দিন বাড়ির সবাইকে খাইয়ে পরে খেয়েছেন। কোনোদিন জানতে চেয়েছেন তারা কী দিয়ে খাচ্ছেন?”
“কী বলতে চাস তুই?”
“মা আপা আমাদের মাছ, মাংস, ডিম দিয়ে খাইয়ে নিজেরা খেতেন সামান্য সবজি দিয়ে নতুবা ডাল দিয়ে। কারণ আমাদের খাওয়ার পর তাদের খাওয়ার মতো মাছ, মাংস, ডিম অবশিষ্ট থাকতো না। বছরের পর বছর ধরে পুষ্টিকর খাবার খেতে পারেন নি বলে মা আপা রক্তশূন্যতায় ভুগে অল্প বয়সে মা’রা যান।”
তারপর বললাম,”অপরিণত বয়সে আপাকে বিয়ে দিয়ে তার সাথে আরেকটি বড়ো অন্যায় করেছেন। যে নি’র্মম আচরণ আপনি আমার মায়ের সাথে আপার সাথে করেছেন একই আচরণ আমার স্ত্রীর সাথে করতে চাই না। আমি চাই না মায়ের মতো, আপার মতো আমার স্ত্রীও অপুষ্টিতে ভুগে অল্প বয়সে মা’রা যাক।”
তারপর দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম,”এখন থেকে বাড়ির পুরুষেরা যা খাবে বাড়ির মেয়েরাও তা খাবে।”
অমত করার ক্ষমতা বাবার ছিলো না। কেননা, সংসার এখন আমার উপার্জনে চলে।
আমার স্ত্রী বাবার সামনে খেতে অস্বস্তি বোধ করতো বলে বাবার খাওয়ার পর আমি আর সে খেতে বসতাম।এবং নিজ হাতে ভালো খাবারগুলো তার পাতে তুলে দিতাম।
বছর দুয়েক পর আমার স্ত্রী যখন গর্ভবতী হলো তখন আত্মীয় স্বজন এবং পাড়া প্রতিবেশীদের অনেকে তাকে কম খাওয়ার পরামর্শ দিলো। আরো পরামর্শ দিলো মৃগেল মাছ, বোয়াল মাছ, শিং, শোল মাছ, শসা, কলা এসব না খেতে।
আমার তখন মনে পড়লো আপার কথা। আমি তাই তাদের কথা শুনলাম না। বাজার থেকে ঐ মাছগুলো কিনে এনে নিজে কেটেকুটে রান্না করতাম। এবং স্ত্রীকে নিয়ে খেতাম। শুধু তাই নয়, গর্ভাবস্থায় স্ত্রীকে কম খাওয়ার বদলে বেশি খাওয়ার দিতাম। সুষম খাবার দিতাম। যাতে মা এবং পেটের সন্তান পর্যাপ্ত পুষ্টি পায়।
আলহামদুলিল্লাহ, যথাসময়ে আমার একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তান হলো। ডেলিভারি নরমাল হলো। এবং আমার স্ত্রীও সুস্থ থাকলো।
আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে বাবা একদিন আমার স্ত্রীকে বললেন,”মেয়েদের স্বাস্থ্যের গুরুত্ব কোনোদিন বুঝতে পারি নি। যদি বুঝতে পারতাম, তাহলে আমার স্ত্রী, মেয়েকে অল্প বয়সে ম’রতে দিতাম না। মেয়েরও বাল্য বিবাহ দিতাম না।”
সেদিন রাতে স্ত্রী আমাকে বললো,”এখনো অনেক মেয়ে অপুষ্টির কারণে রোগে ভুগে কষ্ট পেয়ে অল্প বয়সে মা’রা যাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামে।”
বুক চিরে আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো।
তারপর মেয়েকে কোমল জড়িয়ে ধরে মনে মনে বললাম,”তোমাকে কোনোদিন অপুষ্টিতে ভুগতে দেবো না গো মা। কোনোদিন না।”
সমাপ্ত
“আমাদের মেয়েরা”
– রুদ্র আজাদ
যারা আইডি ফলো না করে গল্প পড়ছেন তাঁদের বলছি আইডি ফলো করেন আইডির গল্প গুলো মন ছুঁয়ে যাবে 👉👉
https://slotbet.online/