দীনবন্ধু মজুমদার : ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সামনে দাড়িয়ে আছি রিকসার জন্য। হঠাৎ এক বৃদ্ধ রিকসাওয়ালা আসলেন। মাথায় পাকা চুল, বয়স ৬০+ হবে তার চোখেমুখে ক্লান্তি আর খুবই অসহায়ত্বের ছাপ। আমি বললাম,
– কাকা, রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে যাবেন?
– হ্যাঁ, যাবো।
– কত দিতে হবে?
– ৪০ টাকা দিয়েন বাবা। (ভাড়া ৪০-৫০ টাকা)
আমি একটু কঠিন হয়ে বললাম,
– কাকা ৩০ টাকা দিবো, যাবেন? গেলে চলেন না গেলে যান।
কাকা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন আচ্ছা বাবা আসেন। আমি চেপে বসলাম রিকসায়। একটুও বুঝতে বাকি রইলো না যে তার আজকে খুব একটা ভাড়া হয়নি। নাহলে ৪০-৫০ টাকার ভাড়া কেউ ৩০ এ নেয়? আধুনিকতার এই যুগে কাকার প্যাডেল রিকসা চলতে লাগলো। কাকার শার্টের ছেঁড়া দাগ আর ময়লা জীর্নশীর্ন শরীর দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে হত দরিদ্র। তীর্ব রৌদের মাঝে তার শরীর বেয়ে টপ টপ করে ঘাম পড়ছিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– কাকার বাসা কোথায়? ফরিদপুরেই?
– না বাবা, কানাইপুর।
– এতদূর থেকে আসেন রোজ?
– হ্যাঁ বাবা।
– রিকসা কি নিজের নাকি কাকা? এই আধুনিক যুগে প্যাডেল রিকশা চালাচ্ছেন, কষ্ট হয়না?
– না বাবা, ভাড়ায় চালাই। অটোরিকশা নিলে বেশি ভাড়া দিতে হয়। প্যাডেল নিলে দিনে ১২০ টাকা দিলেই হয়, অটোরিকশাতে ৩০০ টাকা দিতে হয় এজন্য প্যাডেলই নেই।
– তাও কাকা এই বয়সে প্যাডেল চালানো। কষ্ট তো হয় অনেক। দিনে কত টাকা ইনকাম হয়?
– তা একটু হয়৷ কিন্তু কয়ডা পয়সা বেশি পাওয়া যায় এজন্য প্যাডেলই চালায়। এই সব দিয়ে সারাদিনে হাতে ৩০০-৪০০ থাকে।
– কি বলেন কাকা, এইটুকু টাকা দিয়ে কি সংসার চলে? বাসায় কে কে আছে?
– কি করবো বাবা, জমিজমা নাই, বাড়িতে ২ টা মেয়ে আছে, একটা ছেলে আছে। ছেলেটা দেখে না৷ বউ নিয়ে আলাদা থাকে। বর্তমানে যে অবস্থা জিনিসপাতির দামের, তাতে টেনেটুনে চলে আরকি৷ একদিন অসুস্থ থাকলে পরেরদিন খাবার জোটে না।
কাকার কথার মাঝে একধরনের কষ্ট লুকিয়ে ছিলো। আমি থমকে গেলাম৷ ততক্ষণে স্টান্ডে পৌছে গেছি। কাকা গরমে ঘেমে নেয়ে গেছে। আর আমি আরামে চড়ে আসলাম। মানিব্যাগ থেকে বড় নোটটা বের করে কাকার দিকে এগিয়ে দিতেই তার চোখমুখ শক্ত হয়ে আসলো। বললো,
– বাবা এত টাকা তো সারাদিনের কামাইও না, ভাংতি দিবো কেমনে?
– আমি বললাম তাও তো কথা। এক কাজ করেন ওখান থেকে ২ গ্লাস আখের রস আনেন ভাংতি দিবে।
রসটা এনে ভাংতি টাকা সমেত আমার কাছে দিতে যাবে তখন বললাম
– কাকা রস আপনি খান, এই দুটোই আপনার। আমি গেলাম।
কাকা ততক্ষণে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। সে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,
– কাকা, এই রসও আপনার আর টাকাও আপনার। আজকে বাড়ি চলে যান। রৌদ অনেক। আরেকটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললাম এইটা দিয়ে একটা নতুন শার্ট কিনে নিয়েন। আজকে বাড়িতে ভালো কিছু বাজার নিয়ে যাইয়েন।
কাকা বললো,
– না না বাবা এত টাকা কেন? এত টাকা তো আমি ৩-৪ দিনেও কামাই করি না। ভাড়া তো মাত্র ৩০ টাকা, এত টাকা আমি নিবো কেমনে! না না বাবা আপনি ৩০ টাকাই দেন।
কাকার হাত থরথর করে কাঁপছিলো। আমি তার হাতখানা শক্ত করে ধরে বললাম আমার জন্য দোয়া করবেন। আর নতুন শার্ট কিনে নিয়েন কিন্তু। তাই বলে একটা হাসি দিয়ে হাটা শুরু করলাম৷ খানিকটা সামনে গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম কাকার চোখে পানি এবং সে তখনও সেখানেই দাড়িয়ে আমার প্রস্থান দেখছে।
নোটঃ বর্তমান দেশের যা অবস্থা, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতি, ইনকাম কমে যাওয়া সহ নানান সমস্যায় নিম্ন আয়ের মানুষেরা অনেক কষ্টে আছে। আপনি বা আমি নিজেও আছি। কিন্তু আমি আপনি যেকোনো ভাবে চালিয়ে নিতে পারি। কিন্তু ওনারা তা পারেন না৷ সব সময় চেষ্টা করবেন এরকম কাউকে দেখলে কিছু পয়সা বাড়িয়ে দিতে।
সুত্র ফেসবুক স্ট্যাটাস[:]
https://slotbet.online/