Email : esaharanews@gmail.com
  • অন্যান্য
নোটিফিকেশন
আজকের সর্বশেষ সবখবর

পুরানো কলকাতার কুলিমজুর

ESARA NEWS
আগস্ট ৯, ২০২৩ ৭:৩৮ অপরাহ্ণ । ১১২ জন
Link Copied!

‘পুরানো কলকাতার কুলিমজুর’
©️রানা©️
এখানে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন ঠিক মজুরশ্রেণীর বিকাশ হয়নি। কারণ কলকারখানা তখনও তেমন গড়ে ওঠেনি। তবু বিদেশ থেকে দু’একটি করে কল তথনই আসতে আরম্ভ করেছিল, এবং কল হিসেবে তা নিতান্তই আদিকালের কল হলেও, হাতের বদলে কলের সাহায্যে আমাদের দেশে সেই সময়েই সর্বপ্রথম পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন আরম্ভ হয়েছিল। অর্থাৎ ‘ম্যানুফ্যাকচারের’ বদলে ‘মেসিনোফ্যাকচারের’ যুগের অভ্যুদয় হচ্ছিল তখন৷ হাতের জিনিসের বদলে কলের জিনিসের যুগ আসছিল৷ কলের সেই প্রথম ঐতিহাসিক আবির্ভাবের কথা তখনকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল এইভাবে –

‘‘১১ মার্চ ১৮২৬। তণ্ডুল সম্পাদক নূতন যন্ত্র ৷ অর্থাৎ ধানভানা কল। – ১৫ ফেব্রুআরি বুধবার এগ্রিকলটিউর সোসৈয়িটি অর্থাৎ কৃষি বিদ্যাবিষয়ক সমাজের এক সভা হইয়াছিল৷ ঐ সভায় ডেবিড স্কাট সাহেব কর্তৃক প্রেরিত কাষ্ঠ নিৰ্ম্মিত ব্রহ্মদেশে ব্যবহৃত তণ্ডুলনিষ্পাদক একপ্রকার যন্ত্র অর্থাৎ যাঁতাকল সকলে দর্শন করিলেন। ঐ যন্ত্রে প্রতিদিন কেবল দুই জন লোকে ১০ দশ মোন তণ্ডুল প্রস্তুত করিতে পারে। তাহার একজন কল নাড়ে ইহাতে পরস্পর শ্রান্তিযুক্ত হইলে ঐ কম্মের পরিবর্তন করে। এতদ্দেশে ঢোঁকি যন্ত্রে তিন জন বিনা অর্দ্ধমোনের অধিক তণ্ডুল হওয়া দুষ্কর আর তাঁহারা পরিশ্রান্ত হইলেই ঢোঁকি বন্ধ হয়।’’

‘‘৮ আগস্ট ১৮২৯। কলিকাতার গঙ্গাতীরস্থ কল। – যে কল কএক মাসাবধি কলিকাতার গঙ্গাতীরের রাস্তার উপর প্রস্তুত হইতেছিল তাহা সংপ্রতি পূর্ণ হইয়াছে এবং কলিকাতাস্থ লোকদিগকে সূজি যোগাইয়া দিতে আরম্ভ করা গিয়াছে। এই কলের দ্বারা গোম পেষা যাইবে ও ধান ভানা যাইবে ও মর্দ্দনের দ্বারা তৈলাদি প্রস্তুত হইবে এবং এই সকল কার্য্যে ত্রিশ অশ্বের বল ধারি বাষ্পের দুইট: যন্ত্রের দ্বারা সম্পন্ন হইবে। এতদ্দেশীয় অনেক লোক এই আশ্চয্য বিষয় দর্শনার্থে যাইতেছেন এবং আমরা আপনারদের সকল মিত্রকে এই পরামর্শ দি যে তাহারা এই অদ্ভুত যন্ত্র বাষ্পের দ্বারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই হাজার মোন গোম পিষিতে পারে তংস্থানে গমন করিয়া তাহা দর্শন করেন।’’

আসলে উপরের খবর দুটোতে, কলকাতা শহরে যে নতুন কল এসেছিল সেই খবর ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়েছিল। সেই দুটি কলের মধ্যে একটা ছিল কাষ্ঠনির্মিত চালের কল, আর একটা ছিল সুজি-ময়দা-তেলের কল। চালের কলে দু’জন লোক প্রতিদিন দশ মণ চাল তৈরি করতে পারত, কিন্তু ঢেঁকিতে তিনজন লোকের পক্ষে আধমণ চাল করাই কঠিন হয়ে উঠত। লোকে ভেবেছিল, কলের কি আশ্চর্য মাহাত্ম্য! বাহাদুরি আছে ইংরেজের কলের। “একজন কল লাড়ে”, “আর-একজন চাল দেখে”, এবং তাতেই সারাদিনে কল থেকে দশ মণ চাল বেরিয়ে আসে। গঙ্গাতীরে আরও একটি কল এসেছিল, সেটির ক্ষমতা ছিল আরও বিস্ময়কর। কলকাতার লোক সেই কলের তৈরি সুজি খেতে আরম্ভ করেছিল। কেবল সুজি তৈরি নয়, সেই কলে গম পেষা হত, ধানভানা হত, এবং সরিষা মর্দন করে তৈলও নিষ্কাশন করা হত। হবারই কথা, কারণ তিরিশ অশ্ববলের (horse power) দু’টি বাষ্পীয় যন্ত্র কলটিকে চালাতো। “এতদ্দেশীয় অনেক লোক এই আশ্চর্যা বিষয় দর্শনার্থে যাইতেছেন।” যাবারই কথা, কারণ তখন কলের এমন অপূর্ব মাহাত্ম্য এদেশের লোক দেবদেবীদেরও প্রকাশ করতে দেখেননি। তাই দেবীদর্শনের মতন তাঁরা দলে দলে গঙ্গাতীরে কলদর্শন করতে যাচ্ছিলেন। ১৮ই আশ্বিন ১২৬০ বঙ্গাব্দে, ‘সংবাদ প্রভাকর’ সংবাদ দিয়েছিল যে ‘বহুবাজারের বিখ্যাত ধনিক ‘রাজেন্দ্র দত্তের হৌসে’ (রাজেন্দ্র দত্তের বাড়িতে) আমেরিকা থেকে ছয়টি “অত্যাশ্চর্য্য নূতন কল” এসেছে৷ তাতে অল্প সময়ের মধ্যে “জামা, চাপকান, ইজার, পেণ্টলন” প্রভৃতি নানারকমের পোষাক ও “গনিচটের” থলে পর্যন্ত সেলাই হয়ে থাকে। অতএব ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখেছিল, “ঐ কলের সংখ্যা বৃদ্ধি হইলে মনুষ্যের কত উপকার হইবেক তাহার সংখ্যা করা দুঃসাধ্য” – এবং “ঐ যন্ত্র দর্শনার্থ অনেকেই গমন করিতেছেন, আমারদিগের কোন কোন বন্ধু তদ্দ্বারা কাপড় সেলাই করিয়া লইয়া সেলাই দৃষ্টে চমৎকুত হইয়াছেন।” কিন্তু শুধু কি কৌতূহলী দর্শকদের ভিড় হচ্ছিল কল দেখতে? সেই কলে যাঁরা কাজ করছিলেন তাঁরা কারা? কাষ্ঠনির্মিত ধানভানা কলে, তিরিশ অশ্ববলের ময়দার কলে ও তেলের কলে, আমেরিকার সেলাইকলে, এদেশের লোক যাঁরা সেদিন কাজ করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের পরিশ্রম বেচে জীবিকা অর্জনের জন্য, তাঁরাই ছিলেন আমাদের দেশের আধুনিক শ্রমশিল্পযুগের প্রথম ‘মজুর’। একটা পূর্ণাঙ্গ সামাজিক শ্রেণীরূপে তাঁদের বিকাশ তখনও কলকাতা শহরে ও তার আশপাশে হয়নি। তা না হলেও, এদেশের দরিদ্র গ্রামবাসীদের নাগরিক মজুরশ্রেণীতে রূপায়ণ তখন থেকেই যে আরম্ভ হয়েছিল, তা পরিষ্কার বোঝা যায়। বৈদেশিক পরাধীনতার জন্য যন্ত্রশিল্পের বিকাশ আমাদের দেশে যথানিয়মে হয়নি বলে, গ্রামাঞ্চলের বংশবৃত্তি থেকে উৎখাত হয়ে যাওয়া যাযাবররা এবং অন্যান্য নিঃস্ব ও দরিদ্রশ্রেণীর লোকেরা নতুন শহরের নতুন মজুরশ্রেণীতে পরিণত হতে পারেননি। তাঁদের সেই ঐতিহাসিক পরিণতির পথে বিদেশী শাসকরা অনেক অন্তরায় সৃষ্টি করেছিলেন। তার ফলে তাঁরা শহর ও শহরতলীতে এসে ভিড় করেছিলেন বটে, কিন্তু নতুন নতুন কলকারখানার মজুর হিসেবে নয়, তার চেয়েও অধম ও অসহায় কুলি হিসেবে। তাই দেখা যায়, নতুন শহর কলকাতায় নতুন যুগে যে ‘নাগরিক প্রলেটারিয়েট’ গড়ে উঠেছিল, অন্ততঃ ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত, তাঁরা কারখানার মজুরশ্রেণী ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন স্থান থেকে স্থানান্তরে সদাভাসমান দিনমজুর কুলিশ্রেণী।
পুরনো সরকারী দলিলপত্র ও অন্যান্য বিবরণ থেকে সেদিনের কুলিদের অবস্থার কথা বিশদভাবে জানা যায়। ঊনিশ শতকের তিরিশ বা চল্লিশের দশকে ‘অ্যাডভোকেট জনসন’ কলকাতার কুলিদের সম্বন্ধে লিখেছিলেন – “Hundreds of them are waiting in the streets to be hired; and though, like all Hindoos, they make a most Babel-like noise over their work, and require four to carry that which one English porter would think nothing of, yet they are careful carriers, and generally trust worthy. I had all my furniture removed to another house, three miles distant, by one hundred coolies, for whose services I paid twenty-five rupees.” জনসন সাহেব একশো কুলির মাথায় মাল চাপিয়ে বাড়ি বদল করেছিলেন। তিন মাইল দূর পর্যন্ত মাল বয়ে নিয়ে গিয়ে তাঁরা চার আনা করে মজুরি পেয়েছিলেন। সুতরাং শত শত কুলি যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন, এবং লোক দেখলে বোঝা বইবার জন্য হল্লা করেন, তা হলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কলকাতা শহরে কলকারখানা গড়ে উঠতে দেরী হলেও, ঘরবাড়ি ও পথঘাট নির্মাণের কাজ আঠারো শতকের গোড়া থেকেই আরম্ভ হয়েছিল, এবং ক্রমেই দিন দিন তা বেড়েছিল ছাড়া কমেনি। নতুন শহর কলকাতার বাইরের সেই বিরাট দৈহিক নির্মাণকার্যে সেদিন সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হয়েছিল হাজার হাজার পরিশ্রমী কুলির৷ কলকাতার নতুন নতুন রাস্তা ও ঘরবাড়ি নিয়ে যে বিরাট প্রাসাদপুরী গড়ে উঠতে আরম্ভ করেছিল, তাতে ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য মিস্ত্রীদের দান থাকলেও, দরিদ্র কুলিদের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। প্রাসাদপুরী কলকাতার কঙ্কাল কুলিদের মেহনতেই গড়ে উঠেছিল বলা চলে। কোম্পানির নতুন ফোর্ট উইলিয়ম কেল্লা নির্মাণের হিসেবপত্র ও বিবরণ থেকে আঠারো শতকের দ্বিতীয় দশকে কুলিদের অবস্থা কি ছিল তা জানা যায়৷ ১৭৯৭ সালের ১৩ই জুন তারিখের ‘কৌন্সিলের প্রসিডিংসে’ কুলিদের নিয়োগ পদ্ধতি ও মজুরি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল যে, কেল্লার কুলিদের মজুরি দেওয়া নিয়ে প্রায়ই গণ্ডগোলের সৃষ্টি হত। তার কারণ, কুলিদের মজুরি দেওয়া হত ‘কড়ি’তে এবং তাও তাঁদের হাতে সোজাসুজি দেওয়া হত না, সর্দারদের মারফৎ দেওয়া হত৷ সর্দাররা ও বেনিয়ারা কুলিদের মজুরির একাংশ নিজেদের ‘কমিশন’ হিসেবে আত্মসাৎ করে নিত। কুলিদের কাছে খোঁজ করে দেখা গিয়েছিল যে, তাঁদের প্রতিদিনের মজুরি থেকে ১৫/২০ কড়ি করে কেটে বাকিটা তাঁদের দেওয়া হত। সর্দার বা বেনিয়াদের সেই জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বলত যে, সেটা এই দেশের রীতি ও তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য – “… The Bunnyas and head-men have the conveniency of stopping a small number out of each man’s share, which they call custom, and the coolies have complain ed to me that 15 or 20 cowries per day have been deducted in this manner but these and a great many other had methods might be broke which at present is called custom, the Company would then be better served and the coolies satisfied, they would then conti nue in the works, learn any method that would be desired, and we should not have fresh coolies to teach every day.” (Proceedings, June 13, 1757.) কোম্পানির কাজকর্ম্মে কুলিদের এমনিতেই খুব বেশী মজুরি দেওয়া হত না, বাইরের মজুরির তুলনায় কিছু কম মজুরিতেই তাঁদের কোম্পানির কাজকর্ম করতে হত। কিছুটা সরকারী কাজের মতন তার বিশেষ আকর্ষণ কুলিদের কাছেও ছিল। কিন্তু সেই কম মজুরি থেকেও যখন সর্দার ও বেনিয়ারা কিছুটা ভাগ বসাত, তখন কাজ ছেড়ে দিয়ে তাঁদের স্থানান্তরে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকত না। শুধু কেল্লা নির্মাণের কাজেই কুলিদের এরকম বারবার চলে যেতে হয়েছিল, এবং কোম্পানির কাজে তাতে অনেক ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছিল, অথচ কেল্লা নির্মাণের জরুরী প্রয়োজনীয়তাও তখন যথেষ্ট ছিল। তাই কোম্পানির কর্তারা শেষ পর্যন্ত আদেশ জারী করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে কলকাতার কোন নাগরিক তাঁর ব্যক্তিগত কাজের জন্য কুলি বা মিস্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন না। ‘কৌন্সিলের’ যে বৈঠকে তাঁরা সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেটার বিবরণ ছিল – “The Committee of Works send in a letter to the Board informing us of the difficulty they find in getting laborers and artificers for the fortifications, and desiring the Board will take some method to get them people to carry on the works. Ordered, their letter be entered and that they advertise no artificers shall be employed by the private inhabitants after the first day of February. As to laborers, the Board imagine with proper encouragement a sufficient number may be procured after the harvest of paddy is over.” (Proceedings, January 3, 1758) দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানির কর্তারা সেই কুলি সমস্যার সমাধান করতে পারেন নি। ১৭৬০ সালের ১০ই মার্চ তারিখের সভার বিবরণে তাই দেখা গিয়েছিল, তাঁরা ‘কালেক্টার’কে আদেশ দিয়েছিলেন যে, কেল্লার কাজের জন্য ৮০০০ কুলি জোর করে সংগ্রহ করতে। তাদের প্রস্তাব ছিল – “The works being much retarded for want of coolies, and the farmers not complying with their agreement Ordered the Collector to send peons into the pergunnahs and to bring up by force 8,000, if to be procured.” এই প্রস্তাব থেকে বোঝা যায় যে, কলকাতার ‘কালেক্টার’রা মধ্যে মধ্যে পেয়াদা পাঠিয়ে গ্রামাঞ্চল থেকে লোকজনদের জোর করে শহরে ধরে নিয়ে আসতেন কুলির কাজ করার জন্য। সাধারণতঃ অবশ্য কোম্পানির কাজের জন্যই তাঁদের উপরে জুলুম করা হত। নগর নির্মাণের আদিপর্বে এইভাবে জোরজুলুম করেই গ্রামের দরিদ্র কৃষিজীবীদের, মনে হয়, কলকাতা শহরে কুলিশ্রেণীতে পরিণত করা হয়েছিল। তখন বঙ্গদেশের গ্রামাঞ্চল থেকেও যে অনেক নিঃস্ব কৃষককে কলকাতায় কুলির কাজের জন্য ইংরেজ জমিদাররা জোর করে আমদানি করেছিলেন, তা অনুমান করা অসঙ্গত নয়। কেবলমাত্র বিহারের গ্রামাঞ্চল থেকেই তখন কুলিরা নতুন শহর কলকাতায় আসেননি। পরে বাংলার কৃষকেরা বাংলার গ্রামে ফিরে গিয়ে হয়ত ক্ষেতমজুরি করাকে অনেক বেশী বাঞ্ছনীয় মনে করেছিলেন, নগরের নিষ্ঠুর কুলিমজুরির চেয়ে। বিহারীদের পক্ষে সেটা আর সম্ভব হয়নি।
ঊনিশ শতকের গোড়া থেকে কলকাতা শহরের রাস্তাঘাটের ও ঘর বাড়ির উন্নয়নকর্ম দ্রুতগতিতে আরম্ভ হয়েছিল। প্রধানতঃ ‘লটারি কমিটির’ (Lottery Committee) উদ্যোগেই কলকাতা শহরের সেই উন্নয়ন-পরিকল্পনা কাজে পরিণত করা হয়েছিল। লটারি কমিটির অপ্রকাশিত হাতে-লেখা বিবরণীর মধ্যে কলকাতার কুলিদের সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয়েছিল৷ বিশেষ করে ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কুলিদের পরিশ্রমের মজুরি কি হারে দেওয়া হত সে-সম্বন্ধে অনেক তথ্য কমিটির রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায়। ১৮২০ সালের ২০শে জুলাই তারিখের রিপোর্টে দেখা যায়, কমিটির কর্তারা গভর্নমেন্টকে কলকাতার ‘ডিঙ্গাভাঙ্গা’ খাল বুজিয়ে ফেলার জন্য যে কুলিখরচ হবে, তার একটি হিসেব দাখিল করেছিলেন। বর্তমান ‘ওয়েলিংটন স্কোয়ারের’ (সুবোধ মল্লিক স্কয়ার) উত্তরদিক দিয়ে, ‘বিদ্যাধরী নদী’ থেকে গঙ্গা পর্যন্ত পুব থেকে পশ্চিমে বহমান একটি বড় খাল ছিল, সেটারই নাম ছিল ‘ডিঙ্গাভাঙ্গা খাল’। পরে সেই খাল বুজিয়ে যে রাস্তা করা হয়েছিল সেটারই নাম ‘ক্রীক রো’ (‘ক্রীক’ কথার অর্থ নালা বা খাল)। কমিটি খাল ভর্তি করার হিসেবে বলেছিল যে – চারমাসের জন্য ২০০ কুলি লাগবে, সেই ২০০ কুলির মাসিক মজুরি ৭৫০ টাকা, অতএব চারমাসে কুলিমজুরি বাবদ খরচ হবে ৩০০০ টাকা। সেই হিসাবে প্রত্যেক কুলির মাসিক মজুরি তাহলে ছিল তিন টাকা বারো আনা এবং দৈনিক মজুরি ছিল মাত্র দুই আনা৷ কুলিদের সেই মজুরির কথা রিপোর্টের আরও অনেক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৮২০ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর তারিখের রিপোর্টে ধর্মতলার উত্তরদিক ইঁটবাঁধানোর জন্য যে কুলিখরচ হয়েছিল সেটার হিসেব ছিল –
“জুন ১৮২০: ১৩০০ কুলি: মাসিক তিন আনা হারে
জুলাই ১৮২০: ১৫৬০ কুলি: মাসিক তিন আনা হারে
আগস্ট ১৮২০: ১৫৮১ কুলি: মাসিক তিন আনা হারে”
ঊনিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কুলিদের সেই মজুরির হারের বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি। অনেক দিন পর্যন্ত দু’আনা করেই তাঁদের দৈনিক মজুরি ধার্য ছিল।
কুলিদের তখন একটি বড় কাজ ছিল, পাকা রাস্তার জন্য খোয়া ভাঙা৷ এখনও অবশ্য সব কাজের জন্যই তাঁদের খোয়া ভাঙতে হয়, কিন্তু ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতা, সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও অন্যান্য গ্রামের মেঠোপথগুলি যখন ইঁটখোয়ার পাকা রাস্তায় রূপান্তরিত হয়ে নাগরিক মূর্তি ধারণ করছিল, তখন খোয়াভাঙার কাজটা এক বিরাট মহাযজ্ঞের মতন ব্যাপার ছিল বলা চলে৷ কুলিমজুর দিয়ে তখন খোয়াভাঙানোর কাজটাই নগরকর্তাদের কাছে সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় ছিল। লটারি কমিটির রিপোর্টে কলকাতার রাস্তার একটি সুন্দর বিবরণ পাওয়া যায়। ১৮২০ সালের ২রা মে তারিখে কমিটির কাছে প্রেরিত একটি স্মারকলিপিতে রাস্তার খোয়াখরচ কমাবার জন্য প্রস্তাব করে বলা হয়েছিল – “for the introduction of a more Economical mode of making koah for the repairs of the Roads of Calcutta and its vicinity.” স্মারকলিপিতে নগরকর্তারা ১০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন – “for an approved machine for making koah,” এবং একথাও বলেছিলেন যে – “… at present all Koah for the repairs of Roads in the Town is made by breaking up Bricks into small pieces, the manual labour which is very great and the expense of the article proportionately heavy. The Koah is made from Bricks formed in moulds after the English fashion which also adds to the expense. I imagine it would be equally well, if the better, made from Bricks used by the natives, which for their thinness are more easily burnt, and consequently more durable than those made in the English made.” এই স্মারকলিপিতে একটি প্রয়োজনীয় জ্ঞাতব্য বিষয় আছে। কলকাতা শহরের রাস্তার জন্য তখন যে ইঁট থেকে খোয়া তৈরি করা হত, সেগুলো ইংরেজী ধাঁচের ও ছাঁচের তৈরি হওয়ায় বেশী পুরু বলে তা ভাঙতে কুলিখরচও হত বেশী। কিন্তু আমাদের দেশে যে ইঁট তৈরি হত, তা পাতলা ও হালকা বলে ভাঙতে কষ্ট হত না, এবং সেগুলো পোড়াতেও বেশী সময় লাগত না। লিপিতে তাই এদেশী ইঁট ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছিল। ১৮১৪-১৬ সালে গভর্ণমেন্টের কাছে প্রেরিত লটারি কমিটির রিপোর্টে দেখা যায়, প্রত্যেক বছরে তখন কলকাতার রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য প্রায় ১২০ লক্ষ ইঁট খরচ হত, তার মধ্যে তিনভাগের দু’ভাগ ইঁট লাগত খোয়ার জন্য। খোয়াভাঙার খরচেরও একটা হিসেব পাওয়া যায় রিপোর্টের মধ্যে। ৩৬০০ ইঁট ভাঙতে কুলিদের ২ টাকা করে দেওয়া হত। এই হারে একলক্ষ ইঁট ভাঙতে লাগত ৫৫ টাকা, এবং ৮০ লক্ষ ইঁট ভাঙতে লাগত ৪৪৪৫ টাকা। এদেশী ইঁট ব্যবহার করলে সেই খরচ অনেক কমানো যেতে পারে বলে তৎকালীন নগরকর্তারা সুপারিশ করেছিলেন৷ কুলিদের হাড়ভাঙা খাটুনির জন্য তাঁরা যে বেদনা বোধ করেছিলেন তা নয়, তাঁদের মজুরি বাবদ বেশী খরচ হচ্ছিল বলে ইংরেজী ছাঁচের ইটে খোয়া ভাঙানোতে তাঁদের আপত্তি ছিল।
পুরানো কলকাতার কুলিমজুরদের কথা এইখানেই শেষ করছি। যাঁরা জল টানেন ও কাঠ কাটেন, সভ্যতার ইতিহাসে তাঁদের কথা সামান্য কালো কালির অক্ষরেও লেখা থাকে না। কলকাতার অবশ্য কোন ইতিহাস নেই, তবে ইতিহাসের নামে যে সব ইতিকথা আছে তাতেও কোথাও তাঁদের কথা বিশেষ লেখা নেই। স্তূপাকার সরকারী নথিপত্রের মধ্যে ইতঃস্তত যে-সব বিবরণ ছড়িয়ে আছে, তাই জোড়া দিয়ে একটি চিত্র রচনা করা হয়েছে এখানে। চিত্রটি স্বভাবতঃই নিখুঁত ও অখণ্ড হয়নি। না হলেও ক্ষতি নেই এইজন্য যে, যাঁদের কথা এখানে বলা হয়েছে তাঁদের জীবনেও কোথাও অখণ্ডতা নেই। অথচ এই কুলিমজুররাই কলকাতা শহরে প্রথম নাগরিক জীবনের বুনিয়াদ গড়ে তুলেছিলেন – বন কেটে, জল টেনে, আরামের খোরাক যুগিয়ে, খোয়া ও পাথর ভেঙ্গে ভেঙ্গে।
©️রানা©️
(তথ্যসহায়ক গ্রন্থাবলী:
১- কলিকাতা দর্পণ, রাধারমণ মিত্র।
২- কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, বিনয় ঘোষ।
৩- Interesting History of Kolkata Aka Calcutta, Emily Stehr.)
©️রানা চক্রবর্তী©️