দীনবন্ধু মজুমদার : ট্রেনে উঠে জানালার পাশে সিট টা পেয়ে বসে মোবাইলটা বের করে হেড ফোনটা কানে দিয়ে গান শুনছিলাম। আমার সামনের সীটে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসেছিলেন। দুপুরের সময় ট্রেনে যাত্রী খুব কমই ছিল। হঠাৎ টিটি টিকিট চেক করতে আসতে দেখে বয়স্ক ভদ্র লোকটি বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁর হাবভাব দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, টিকিট কি কাটা হয় নি আপানার ?
ভদ্র লোকটি খুব শান্ত স্বরে বললেন, ট্রেন স্টেশনে ঢুকে যাওয়ায় টিকিট কাটার সময় পাইনি। আর আমার কাছে ফাইন দেওয়ার মতো টাকাও নেই ।
আমি তাঁকে অভয় দিয়ে বললাম, চিন্তা করবেন না, ফাইন এর টাকা টা আমি দিয়ে দেব। আমার কথা শুনে তিনি খুবই আনন্দিত হলেন।
কিন্তু টিটিকে দেখলাম কোন কারন বশত আমাদের কাছে টিকিট চেক করতে না এসে হিজলি স্টেশনে নেমে পড়লো। যাই হোক আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যাবেন ?
বয়স্ক লোকটি যেন একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন । তারপর বললেন হাওড়া যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু এবার ভাবছি বাঁকুড়া যাব ।
তাঁর কথা শুনে আমি একটু অবাক হলাম । তিনি বললেন, জানো বাবা, আমার নাম বীরেন মণ্ডল, আমি একটা কোম্পানিতে কাজ করতাম । দুই ছেলে আর এক মেয়ে রেখে আমার স্ত্রী মারা যায়। আর বিয়ে করি নি এই ভয়ে যে, সতীন মা এসে আমার বাচ্চাদের উপর অত্যাচার করতে পারে। বাবা হয়েও আমি তাদের মায়ের মতো খুব আদর যত্ন দিয়ে বড় করেছিলাম। যা টাকা রোজগার করতাম ছেলে দুটোর পড়াশুনার পেছনেই খরচ করে ফেলতাম। বড় ছেলে এখন স্কুল মাস্টার আর ছোট ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। মেয়েটাও আমার পড়াশুনায় অনেক ভাল ছিল। কিন্তু তিন জনের পড়ার খরচ চালাতে পারছিলাম না বলে মেয়েকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলাম। বড় ছেলে দাঁতন এ থাকে আর ছোট ছেলে হাওড়া তে ।
আমি বললাম , তাহলে আপনি ছোট ছেলের কাছে যাবেন? কথা টা শুনে তিনি খুব করুন সুরে বললেন , দুই ছেলে বিবাহিত, তাদের ছেলে- মেয়ে নিয়ে থাকে। আমাকে তারা ভাগ করে নিয়েছে । আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ‘ ভাগ করে নিয়েছে মানে’ ?
মাসে ১৫ দিন বড় ছেলে আর ১৫ দিন ছোট ছেলের বাড়ীতে থাকি, তারা ভাগ করে এই বৃদ্ধ বাবার প্রতি ছেলে হওয়ার দায়িত্ব পালন করছে ।
ছোট ছেলের বাড়ীতে ছিলাম। শরীরটা খুব খারাপ ছিল , কিন্তু ১৫ দিন হয়ে গিয়েছিল। বউমাকে বললাম একদিন পরে যাব। কিন্তু বউ মা শুনল না , চলে যেতে বলল বড় ছেলের বাড়ীতে, তা নাহলে আর খাবার মিলবে না। অসুস্থ শরীর নিয়েই আমি বড় ছেলের বাড়ীতে এসে দেখি দরজায় তালা ঝোলানো। তারা জানে আমি আসবো, তবুও কোথাও বেড়াতে চলে গিয়েছে পরিবার নিয়ে।
আসলে তারা কেউ এই অসুস্থ বুড়োটার দেখভাল করার দায়িত্ব নিতে চায় না।
কথা গুলো বলতে বলতে বীরেন বাবুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
তিনি কাঁদতে কাঁদতে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন , ছেলে দুটোর পরিবর্তে মেয়েটাকে যদি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতাম তাহলে খুব ভালো হতো। মেয়ে বাঁকুড়াতে থাকে। জামাই এর একটা ভুষিমাল দোকান আছে। আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। মেয়ে আমার অঙ্গনওয়ারীতে একটা কাজ করে। অনেক বার ডেকেছে, বাবা তুমি আমাদের বাড়ীতে এসে থাকো। ছেলে থাকতে মেয়ের বাড়ীতে গিয়ে থাকা সমাজ ভালো চোখে দেখে না। তবুও মেয়ের বাড়িতেই যাব ভাবছি। আমার কাছে ভালো খাওয়া দাওয়ার চেয়ে একটু ভালোবাসাই অনেক বেশি মুল্যবান।
মেয়ের কাছে গিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইব প্রথমে … তার ভাইদের পড়াশুনার খরচ চালানোর জন্য তার পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়ে তার জীবনের স্বপ্ন গুলো ধ্বংস করে দিয়েছি। তখন ভাবতাম, মেয়েরা তো বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ী চলে যাবে। বুড়ো বয়সে দেখাশোনা তো ছেলেরাই করবে। তাই মেয়েকে আর পড়ালাম না। তার স্বপ্ন গুলো ধ্বংস করে দিয়েছিলাম।
বীরেন বাবুর কথা গুলো শুনে খুব কষ্ট হচ্ছিল, মনে মনে বললাম, বাবা মা এর দায়িত্ব ছেলে মেয়ে যতদিন না সমান ভাবে বহন করতে শিখবে ততদিন হয়তো সমাজে নিজেদের ছেলে- মেয়ের প্রতি বাবা মা এর ধারনা বীরেন বাবুর মতই থাকবে,
এরকম কেও করো না প্লীজ,,,,আগামী প্রজন্ম তাহলে সেটাই করবে,,,আমার বাবা মা তো আমার কাছে ভগবান।
https://slotbet.online/