Email : esaharanews@gmail.com
  • অন্যান্য
নোটিফিকেশন
আজকের সর্বশেষ সবখবর

এক ভালো মহারাজের গল্প

ESARA NEWS
আগস্ট ২৭, ২০২৩ ১১:৪৭ অপরাহ্ণ । ৫৫ জন
Link Copied!

🌻| এক ভালো মহারাজের গল্প…|🌻

রাজা মহারাজা বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে লাল লাল চোখের ইয়া গোঁফওয়ালা কোন মানুষের মুখ। দিনে সে প্রজা ঠ্যাঙায় আর রাতে তাদের মেয়ে বউদের নিয়ে জোর করে ফুর্তি করে। দুশো বছরের শাসনকালে দেশীয় রাজাদের এই চিত্রটাই এঁকে গেছে বৃটিশরা। কিন্তু যাদের কথা তারা বলে যায়নি, আজ বলবো সেরকম এক রাজার কথা!💙

দিগ্বিজয় সিংজী জাদেজার নাম শুনেছেন…? শোনেননি, কি করে শুনবেন এই ইতিহাস তো বৃটিশরা লিখে যায়নি! আচ্ছা মহারাজ রঞ্জিত সিংজীর নাম শুনেছেন তো, যার নামে ক্রিকেটের রঞ্জী ট্রফি? এনারই ভাইপো দিগ্বিজয়।

রাজকোটে পড়াশোনা করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনের Malvern College এ ভর্তি হন। স্নাতক হবার পর ১৯১৯ সালে বৃটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। মিশর দখলে অসামান্য অবদানের জন্য পুরস্কার ও পান। প্রায় দু’দশক কাজ করার পর ক্যাপ্টেন পদে প্রমোশন পান এবং ১৯৩১ এ বাহিনী থেকে অবসর নেন। কাকার মৃত্যুর পর ১৯৩৩ সালে জামনগরের সিংহাসনে বসেন। সেবামূলক কাজের জন্য ১৯৩৫ সালে বৃটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু এসবের জন্য তাঁকে দেশবাসী মনে রাখেনি। তাহলে…?

পয়লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯, হিটলারের ঝটিকা বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো পূর্ব ইউরোপের ছোট্ট দেশ পোল্যান্ডের ওপর । সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত পোল বাহিনীর প্রতিরোধ ঝড়ের মুখে কুটোর মতো উড়ে গেল । রাজধানী ওয়ারশ সহ পতন হলো গোটা পোল্যান্ডের । আর সেই সাথে সূচনা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের….!

তার আগে চলুন একটু জেনে নিই ঘটনার প্রেক্ষাপট। ১৯৩৯ সালের আগষ্ট মাসে সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শে চলা দুই বৃহৎ রাষ্ট্রের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। তাতে লেখা ছিলো কোন পরিস্থিতিতেই তারা একে অপরকে আক্রমণ করবে না। ইতিহাসের ছাত্ররা এটিকে মলোটভ- রিবেনট্রপ চুক্তি বলে জানে। কিন্তু এই সন্ধি স্বাক্ষরিত হবার পেছনের অলিখিত শর্তটা ছিল মারাত্মক। দুই ক্ষমতাধর দেশের রাষ্ট্রপ্রধান মানে স্ট্যালিন ও হিটলার ঠিক করলেন তাঁরা চুপচাপ পোল্যান্ড দখল করে নেবেন। মধ্য ইউরোপের এক ছবির মতো ছোট্ট দেশ পোল্যান্ড, রাজধানী ওয়ারশ্।
আর ঠিক পয়লা সেপ্টেম্বর হিটলারের ঝটিকা বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো দেশটির ওপর। পোল্যান্ডের পশ্চিম অংশ চলে গেল জার্মানির দখলে। পনেরো দিন পর অর্থাৎ ১৬ই সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডের রক্ষাকর্তা হিসেবে পূর্ব অংশে ঢুকে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের রেড আর্মি।

সোভিয়েত সেনা স্থানীয় পোলিশ দের আশ্বস্ত করেছিল এই বলে যে তারা নাজী বাহিনীর হাত থেকে তাদের বাঁচাতে এসেছে। যদিও অল্পদিনের মধ্যেই পোলিশদের মোহভঙ্গ হয়। রুশ সিক্রেট পুলিশ প্রায় পাঁচ লাখ নাগরিককে বন্দী করে অকথ্য অত্যাচার চালায়। এরপর ১৯৩৯ সালে এক লোকদেখানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পোল্যান্ডে। সেই নির্বাচনের ফল দেখিয়ে এবার তারা ‘গণতান্ত্রিকভাবে’ দেশটির অর্ধেক দখল করে নেয়। পদস্থ আমলা ও সেনা আধিকারিকদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। নিখোঁজ হয়ে যায় বহু সাধারণ পোলিশ নাগরিক। সে সময় রুশ অধিকৃত পোল্যান্ডের জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি।

১৯৪০ সালে পোল্যান্ডের পশ্চিমাংশে নাজীরা চালু করে কুখ্যাত অসউইজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। সেসময় এটি ছিল পোল্যান্ডের সবচেয়ে বড় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। মূলত রাজনৈতিক বন্দি শিবির হিসেবে এই ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। এখানে জার্মানির শত্রু এবং ইহুদিদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হত। অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বন্দিদের অনেকেই মৃত্যু চাইতেন। বন্দীদের মারা হতো গ্যাস চেম্বারে এবং সমর্থ বন্দীদের ওপর জার্মান বিজ্ঞানীরা চালাতো নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা। মারা গিয়েছিলেন অসংখ্য ইহুদী ও নাজী বিরোধী মানুষ। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে হলোকাস্টের সময়ে অসউইচ বা আউৎসভিচ কারাগারে বন্দীদের ওপর নারকীয় এই অত্যাচারের কাহিনী শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব।

পিছিয়ে ছিলো না সোভিয়েত ইউনিয়নও।১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ এই দুবছরে স্তালিন পোলিশদের স্বভূমি থেকে জোর করে সাইবেরিয়ার দুর্গম এলাকায় পাঠিয়ে দেয়। মূলত সেখানকার লেবার ক্যাম্প গুলোতে কাজ করার জন্য। স্থানীয় ভাষায় এগুলো কে বলা হতো ‘গুলাগ’! নামে শ্রম শিবির হলেও আসলে নরকের থেকে কম ছিল না। ভয়ঙ্কর ঠান্ডার মধ্যে বন্দীদের দিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করানো হতো। দেয়া হতো না পর্যাপ্ত খাবার বা শীতবস্ত্র। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী এখানে আসা ৪০ লাখ মানুষের মধ্যে ১৭ লাখ মারা যায় অনাহারে ও শীতে, যার এক-তৃতীয়াংশ ছিল নাবালক বা নাবালিকা।

পরিস্থিতি বদলে যায় অনাক্রমন চুক্তি ভেঙে হিটলার যখন রাশিয়ার ওপর হামলা চালায়। সোভিয়েত প্রশাসন একরকম বাধ্য হয়ে মুক্তি দেয় পোলিশ নাগরিকদের। কিন্তু এরা এখন যাবে কোথায় ?

কুখ্যাত সব বন্দীশিবিরের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রায় একহাজার ভীত সন্ত্রস্ত পোলিশ নাগরিক অজ্ঞাত কোন নৌবন্দর থেকে অজানা পথে পাড়ি দিলো। যাত্রীদের মধ্যে ছিল পাঁচশো মহিলা আর দুশো শিশু । নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছিলো তাদের এই সমুদ্র যাত্রা ।

ইউরোপের বহু বন্দর ঘুরেও নামার অনুমতি না পেয়ে শেষমেষ তারা এডেন হয়ে পৌঁছুলো তেহরাণ বন্দরে । সেখানেও নামতে না পেরে তারা এলো বোম্বাই বন্দরে । কিন্ত সেখানকার বৃটিশ গভর্নর দুদিন জাহাজ নোঙর করার পরও নামার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন ।

গুজরাটের এক দেশীয় রাজ্য নওনগিরি, বর্তমান নাম জামনগর। ওখানকার মহারাজ দিগবিজয় সিংহ সেসময় বোম্বাইতে । সব শুনে তিনি জাহাজ পাঠিয়ে দেন নিজের রাজ্যে । রাজধানী থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে সমুদ্র তীরে বালাচাডি নামে এক গ্রামে তাদের থাকার জন্য শিবির নির্মাণ করে দেন । তৎকালীন ইংরেজ শাসকরা এই বিদেশী রিফুইজীদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে যথেষ্ট আপত্তি জানিয়েছিল, কিন্ত মহারাজ কোন কিছুই পরোয়া করেন নি ।

শুধু তাদের থাকার জায়গা নয়, কমবয়সীদের জন্য বোম্বাই থেকে ইংরেজ শিক্ষক আনিয়ে তাদের পড়াশোনা শেখারও ব্যবস্থা করে দেন । দেশীয় রান্না তারা খেতে পারতো না বলে গোয়া থেকে আনিয়েছিলেন পর্তুগীজ বাবুর্চী..!

নিজেদের দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকা এই শরণার্থীরা যাতে অসুবিধায় না পড়ে, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন মহারাজ । সদাই বলতেন, “Do not consider yourself orphans. You are now Nawnagaris and I am Bapu, father of all the people of Nawanagar, so also yours.”

ছয়বছর পর 1946 এ যুদ্ধ থামলে এই পোল্যান্ড বাসীরা দেশে ফিরে যায় । কিন্ত স্বল্প কালের এই ভারতবাসের স্মৃতি তারা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে আজও । পরবর্তী কালে এই শিশুদের একজন সেদেশের প্রধানমন্ত্রী হয় । জাম সাহেবের স্মৃতিতে পোল্যান্ডের বহু রাস্তা নামাঙ্কিত করা হয়েছে এবং সরকারী অনেক প্রকল্প এখনও তার নামে চলে ।সেদিনের সেই রিফুইজীদের বংশধররা নিয়ম করে জামনগরে আসেন শুধুমাত্র মহারাজ কে শ্রদ্ধার্ঘ জানাতে । প্রসঙ্গত ক্রিকেটার অজয় জাদেজা ঐ মহারাজেরই বংশধর ।

এটাই এই প্রাচীন দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি…“বসুধৈব কুটুম্বকম..!”💛 জামনগরের মহারাজ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন The world is a family.‌🌷

#কলমে ✍🏻 স্বপন সেন #