একবার তাঁর চোখের সামনে তাঁর মা’কে লাথি মেরেছিল এক ব্রিটিশ | ছোট্ট ছেলেটা সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল এর প্রতিশোধ সে নেবেই | তবে তাঁর পরিবারের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাস বহু পুরোনো | কি সেই ইতিহাস ? তাহলে ফিরে যেতে হবে প্রায় ১৬০ বছর..💫🌻
🇮🇳 #স্বাধীনতার_নায়করা পর্ব ~ ৩০ 🇮🇳
অত্যাচারী ব্রিটিশ নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে নদীয়া জেলায় যে নীল বিদ্রোহের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তার অন্যতম নায়ক ছিলেন দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরন বিশ্বাস | দিগম্বর বিশ্বাসের নিজের ভাই ছিলেন সর্বানন্দ বিশ্বাস | এই সর্বানন্দ বিশ্বাস ছিলেন সেই ছেলেটির পিতামহ | আর সেই ছেলেটির নাম..?
বসন্তকুমার বিশ্বাস | জন্ম নদীয়ার কৃষ্ণনগরের থেকে দশ কিলোমিটার দূরে পোড়াগাছা পরিবারের এক সাধারণ পরিবারে | পড়তেন মুড়াগাছা হাইস্কুলে | পড়াশোনায় তার বিশেষ মন নেই | ক্লাসেই পড়তেন স্বদেশী বই | বিষয়টা নজর এড়াল না হেডমাস্টার ক্ষীরোদচন্দ্র গাঙ্গুলির | তিনিই স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন বসন্তকে | পড়ে শোনাতেন “দেশের কথা” আর দেশ বিদেশের বিপ্লবীদের গল্প | ক্ষীরোদচন্দ্র গাঙ্গুলির সঙ্গে পরিচয় ছিল বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের | তিনি বসন্তকে পাঠিয়ে দেন তার কাছে | সেখানেই অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত স্বদেশী পণ্যের দোকান “শ্রমজীবী সমবায়” কিছুদিন কাজ করেছিলেন বসন্ত |
এরপর বসন্ত বিশ্বাস আসেন চন্দননগরে | সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় মহানায়ক রাসবিহারী বসুর | তিনিই বসন্তকে নিয়ে আসেন উত্তর ভারতের কাজে | দেরাদুনে রাসবিহারী বসুর কাছে তিনি ছিলেন পাঁচ ছয় মাস | তারপর বসন্তকে তিনি পাঠিয়ে দেন লাহোরে বালমুকুন্দের বাড়িতে | বসন্ত বিশ্বাসের পরিবারের তখন চরম আর্থিক দুরবস্থা | অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তখন বসন্ত বিশ্বাসের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য পাঠাতেন | এই খবর একদিন সে জেনে যায় |
অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বসন্ত বিশ্বাস বলেছিল, “ বিপ্লবীরা কি ভাড়াটে সৈনিক যে বিপ্লবী কাজ করার জন্যে পয়সা নিতে হবে? আমি পয়সার জন্যে এসব করি না..।” 🇮🇳
লাহোরে বসন্ত বিশ্বাস কিছুদিন কাজ নিয়েছিলেন পপুলার ডিসপেন্সারিতে | থাকতেন ঝিলাম নদীর তীরে বালমুকুন্দের খাপরার ঘরে।
১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর | সময় সকাল ১১টা বেজে ৪৫মিনিট | হাতির পিঠে বসা সস্ত্রীক বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ দিল্লী স্টেশন থেকে দিল্লীর চাঁদনী চকের পথ ধরে আম-দরবারে যাচ্ছিলেন বঙ্গভঙ্গ বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য, তিল ধারণের জায়গা নেই | অসংখ্য মহিলা পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনের তৃতীয় তলায় শোভাযাত্রা দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু এবং ষোড়শী বালিকা লীলাবতী। রাসবিহারী বসু সবকিছু সর্তকতার সাথে তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন | লীলাবতীও রাসবিহারী বসুর ইঙ্গিতের জন্য অপেক্ষা করছেন।
এমন সময় এক মহিলা লীলাবতীকে জিজ্ঞেস করে “তেরি নাম ক্যা বহিনী?” লীলাবতী রাসবিহারীর দিকে দৃষ্টি রেখে বলেন,”মেরী নাম লীলাবতী..।”
ততক্ষণে শোভাযাত্রাটি ভবনের একেবারে নিকটে চলে এসেছে। রাসবিহারী বসু মহিলাদের দৃষ্টি শোভাযাত্রা ফেরানোর জন্য জোরে বলে উঠেন, “বড় আজব, সামনে দেখ বহিনি”। মহিলারা অন্যদিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে রাসবিহারী বসু লীলাবতীকে ইঙ্গিত দেন। লীলাবতী তৎক্ষণাৎ বড়লাটকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেন। হাতির গায়ে বোমাটা পড়ায় লর্ড হার্ডিঞ্জ আহত হয়ে নীচে পড়ে যান, কিন্তু প্রাণে বেঁচে যান। হাতির পিঠে বসে থাকা লেডী হার্ডিঞ্জ সংজ্ঞাহীন হয়ে পরেন। ঘটনায় বড়লাটের পার্শ্বচর এক জমাদার ও মাহুত মারা যান। বোমার আঘাতে একটা ছোট ছেলেরও মৃত্যু হয়। ষোড়শী বালিকা লীলাবতী বেশে যিনি ছিলেন তিনি হলেন বসন্ত বিশ্বাস | পরিকল্পনা মত মুহূর্তের মধ্যে রাসবিহারী বসু আর বসন্ত বিশ্বাস জনারণ্যে মিশে গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে উধাও হয়ে যান।
প্রায় দুই বছর আত্মগোপন করে থাকার সময় বসন্তকুমার বিশ্বাসের পিতৃবিয়োগ হয়েছে বলে জানতে পেরে তিনি চলে আসেন গ্রামের বাড়ি নদীয়া জেলার পোড়াগাছায়। ক্ষৌরকর্মের আগের দিন কিছু বিশেষ কাজে বসন্ত বিশ্বাস কৃষ্ণনগরে কাকা প্রতাপচন্দ্রের বাসায় আসেন। সেদিন ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯১৪। সেই বাসায় সদ্য পিতৃহারা বসন্তের যখন হবিষ্যি গ্রহণের উদ্যোগ চলছিল ঠিক তখনই পুলিশ বাড়িটিকে ঘিরে ফেলে। ধরা পড়ে যান বসন্ত বিশ্বাস |
১৯১৪ সালের ২৩ মে দিল্লিতে দিল্লি-লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি শুরু হয় এবং ৫ অক্টোবর বসন্তকুমারকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। ঐ দলের দীর্ঘদিনের সহযোগী দীননাথ ও সুলতানচাঁদ নিজেদের জীবন রক্ষার তাগিদে ইংরেজ শাসকদের প্ররোচনায় বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজসাক্ষী হয়ে অনেক গোপনীয় কথা আদালতে ফাঁস করে দেয়। দীননাথ ১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর দিল্লীতে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর উপর বোমা বিষ্ফোরণে রাসবিহারী বসু, বসন্ত বিশ্বাস ও অন্যান্যদের যুক্ত থাকার কথাও ফাঁস করে দেয়। দিল্লীতে ভাইসরয়ের (বড়লাট-এর) উপর বোমা-নিক্ষেপের দিনকয়েক বসন্ত বিশ্বাস যে লাহোরে ছিলেন না তাও ফার্মেসীর ক্যাশ রেজিস্টার থেকে প্রমাণ হয়ে যায়। কিন্তু শুধুমাত্র লাহোরে অনুপস্থিতির জন্যই তাঁকে দিল্লী বোমা বিস্ফোরণের আসামী বলে আইনগতভাবে অভিযুক্ত বলে প্রমাণ করে না।’দিল্লী-লাহোর ষড়যন্ত্র’ মামলায় দিল্লী আদালতের এডিশানেল সেশন্স জাজ মি: এম. হ্যারিসন তার ৫ অক্টোবর ১৯১৪ এর রায়ে তিনজনকে প্রাণদণ্ড আর অপর তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। অনেকেই জানেন না প্রথমে বসন্ত বিশ্বাসকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
স্বভাবতই নাবালক প্রধান অভিযুক্তের প্রাণদণ্ড না হওয়ায় প্রতিহিংসাপরায়ণ ইংরেজ শাসকরা এই রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ইংরেজ সরকার দিল্লী আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে লাহোরে পঞ্জাব উচ্চ আদালতে আবেদন করে। আরো একবার বিচারের নামে প্রহসনের শেষে ১৯১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিচারক স্যার ডোনাল্ড জনস্টোন ও মি: রেটিগান দিল্লী আদালতের দেওয়া শাস্তিকে পরিবর্তন করে বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। দিল্লী আদালতের বিচারক হ্যারিসনও এই ঘৃণ্য চক্রান্তে জড়িত ছিলেন। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার জন্যে তিনি ফাইলে বসন্ত বিশ্বাসের বয়স দুবছর বাড়িয়ে প্রমাণ করেন তিনি তাঁর কৃত অপরাধের তীব্রতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত ছিলেন। পুলিশের শত অত্যাচারেও সে ছিল নির্বিকার – একটা কথাও তাঁর কাছ থেকে বের করতে পারেননি ব্রিটিশরা |
১৯১৫ সালের ১১ মে আম্বালা জেলে বসন্তকুমার বিশ্বাস অত্যন্ত শান্ত ও অবিচলিত মনে ফাঁসির মঞ্চে ওঠেন | মুখে তখনও লেগেছিল হাসি | সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন দিল্লির সেরিফ আলেকজান্ডার ম্যাকারাবি | তিনি লিখেছিলেন, “ In a word his steadiness, composour and resolution throughout the whole of this melancholy transaction were equal to any example of fortitude I have ever read or heard of..!”
বিপ্লবী রাসবিহারী বসু তাঁর প্রিয় শিষ্য বসন্ত বিশ্বাসকে কখনও ভুলে যাননি। বসন্ত ছিল তাঁর নিজের ভাইয়ের মত | জাপানের টোকিও শহরে মাদাম তেৎসু-কোং হিওচির বাগানে রাসবিহারী নাকি নিজহাতে একটা ওক গাছের ফলক প্রোথিত করে স্মারক হিসাবে বসন্তের প্রতি শ্রদ্ধা ও সন্মান জানিয়েছিলেন।
এগুলো ইতিহাস | সত্যি ইতিহাস বদলানো যায় না |বসন্ত কুমার বিশ্বাসকে আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম..🌸🌿
♦️তথ্যসূত্রঃ অগ্নিযুগের ফাঁসি (শুভেন্দু মজুমদার)
© এক যে ছিলো নেতা
| #এক_যে_ছিলো_নেতা |
#স্বাধীনতার_নায়করা #azaadikaamritmahotsav #77thindependenceday #india #harghartiranga #Har_Ghar_Netaji #স্বাধীনতা #বাংলা #বিপ্লবী #স্বাধীনতা_আন্দোলনের_পঞ্চপান্ডব
📌 Facebook এর পাশাপাশি আমরা পথচলা শুরু করেছি YouTube এও.. আমাদের কাজ ভালো লাগলে আমাদের channel টি Subscribe করে পাশে থাকবেন.. এই রইলো link 👇 https://appopener.com/yt/19zgtp0em