✨✨✨২৪। ঋষ্যশৃঙ্গের উপাখ্যান✨✨✨
পাণ্ডবগণ নন্দা ও অপরনন্দা নদী এবং ঋষভকূট পর্বত অতিক্রম করে কৌশিকী নদীর তীরে এলেন। লোমশ বললেন, ওই বিশ্বামিত্রের আশ্রম দেখা যাচ্ছে। কশ্যপগোত্রজ মহাত্মা বিভাণ্ডকের আশ্রমও এইখানে ছিল। তাঁর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের তপস্যার প্রভাবে ‘ইন্দ্র অনাবৃষ্টির কালেও জলবর্ষণ করেছিলেন। তাঁর আখ্যান বলছি শোন।-
একদিন বিভান্ডক মুনি দীর্ঘকাল তপস্যায় শ্রান্ত হয়ে কোনও মহাহ্রদে স্নান করছিলেন এমন সময় উর্বশী অপ্সরাকে দেখে তিনি কামাবিষ্ট হলেন।
তৃষিতা হরিণী জলের সঙ্গে বিভান্ডকের শুক্র পান করে গর্ভিণী হল এবং যথাকালে ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রসব করলে। এই মুনিকুমারের মস্তকে একটি শৃঙ্গ ছিল, তিনি সর্বদা ব্রহ্মচর্যে নিরত থাকতেন এবং পিতা বিভাণ্ডক ভিন্ন অন্য মানুষও দেখেন নি। এই সময়ে অঙ্গদেশে লোমপাদ নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি দশরথের সখা। আমরা শুনেছি, লোমপাদ ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতের প্রতি অসদাচরণ করেছিলেন সেজন্য ব্রাহ্মণগণ তাকে ত্যাগ করেন এবং ইন্দ্রও জলবর্ষণে বিরত হন, তার ফলে প্রজারা কষ্টে পড়ে। একজন মুনি রাজাকে বললেন, আপনি প্রায়শ্চিত্ত করে ব্রাহ্মণদের কোপ শান্ত করুন এবং মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে আনান, তিনি আপনার রাজ্যে এলে তখনই বৃষ্টিপাত হবে।
লোমপাদ প্রায়শ্চিত্ত করে ব্রাহ্মণদের প্রসন্ন করলেন এবং ঋষ্যশৃঙ্গকে আবার জন্য শাস্ত্রজ্ঞ কর্মকুশল মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তিনি প্রধান প্রধান বেশ্যাদের ডেকে আনিয়ে বললেন, তোমরা ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রলোভিত করে আমার রাজ্যে নিয়ে এস। বেশ্যারা ভীত হয়ে জানালে যে তা তাসাধ্য। তখন এক বৃদ্ধ-বেশ্যা বললে, মহারাজ, আমি সেই তপোধনকে নিয়ে আসব, আমার যা যা আবশ্যক ত আমাকে দিন। রাজার নিকট সমস্ত প্রয়োজনীয় বস্তু ও ধনরত্নাদি পেয়ে সেই বৃদ্ধবেশ্যা একটি নৌকায় কৃত্রিম বৃক্ষ গুল্ম লতা ও পুষ্পফল দিয়ে সাজিয়ে রমণীয় আশ্রম নির্মাণ করলে এবং কয়েকজন রূপযৌবনবতী রমণীকে সঙ্গে নিয়ে বিভাণ্ডকের আশ্রমের অদূরে এসে নৌকা বাঁধলে।
বিভাণ্ডক তার আশ্রমে নেই জেনে নিয়ে সেই বৃদ্ধা তার বুদ্ধিমতী কন্যাকে উপদেশ দিয়ে পাঠিয়ে দিলে। বেশ্যাকন্যা ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে গিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করে বললে, আপনারা এই আশ্রমে সুখে আছেন তো? ফলমূলের অভাব নেই তো? আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, আপনাকে জ্যোতিঃপুঞ্জের ন্যায় দেখছি, আপনি আমার বন্দনীয়, পাদ্য ফল মূল দিয়ে আমি আপনার যথাবিধি সৎকার করব। এই কৃষ্ণাজিনাবৃত সুখাসনে সুখে উপবেশন করুন। আপনার আশ্রম কোথায়? আপনি দেবতার ন্যায় কোন্ ব্রত আচরণ করছেন?
বেশ্যাকন্যা বললে, এই ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতের অপর দিকে আমার রমণীয় আশ্রম আছে। আমার স্বধর্ম এই, যে আমি অভিবাদন বা পাদ্য জল গ্রহণ করতে পারি না। আপনি আমাকে অভিবাদন করবেন না, আমিই করব, আমার ব্রত অনুসারে আপনাকে আলিঙ্গন করব। ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, আমি আপনাকে পক ভল্লাতক আমলক করূষক ইদ ধন্বন ও প্রিয়লক ফল দিচ্ছি, আপনি ইচ্ছানুসারে ভোজন করুন। বেশ্যাকন্যা উপহৃত ফলগুলি বর্জন করে ঋষ্যশৃঙ্গকে মহামূল্য সুন্দর সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য, সুগন্ধ মাল্য, বিচিত্র উজ্জ্বল বসন এবং উত্তম পানীয় দিলে, তার পর নানা প্রকার। খেলা ও হাস্যপরিহাসে রত হল। সে লতার ন্যায় বক্র হয়ে কদুক নিয়ে খেলতে লাগল এবং ঋষ্যশৃঙ্গের গায়ে গা দিয়ে বার বার আলিঙ্গন করলে। মুনি-কুমারকে এইরূপে প্রলোভিত করে এবং তাকে বিকারগ্রস্ত দেখে সে অগ্নিহোত্র-হোম করবার ছলে ধীরে ধীরে চ’লে গেল।
ঋষ্যশৃঙ্গ মদনাবিষ্ট হয়ে অচেতনের ন্যায় শূন্যমনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। ক্ষণকাল পরে বিভান্ডক মুনি আশ্রমে ফিরে এলেন। তার চক্ষু পিঙ্গলবর্ণ, নখের অগ্রভাগ থেকে সমস্ত গাত্র রোমাবৃত। পুত্রকে বিহ্বল দেখে তিনি বললেন, বৎস, তোমাকে পূর্বের ন্যায় দেখছি না, তুমি চিন্তামগ্ন অচেতন ও কাতর হয়ে আছ কেন? কে এখানে এসেছিল? ঋষ্যশৃঙ্গ উত্তর দিলেন, একজন জটাধারী ব্রহ্মচারী এসেছিলেন, তিনি আকারে অধিক দীর্ঘ নন, খবও নন, তার বর্ণ সুবর্ণের ন্যায়, চক্ষু পদ্মপলাশতুল্য আয়ত, তিনি দেবপুত্রের ন্যায় সুন্দর। তার জটা সুদীর্ঘ, নির্মল কৃষ্ণবর্ণ, সুগন্ধ এবং স্বর্ণসূত্রে গ্রথিত। আকাশে বিদ্যুতের ন্যায় তাঁর কণ্ঠে কি এক বস্তু দুলছে, তার নীচে দুটি রোমহীন অতি মনোহর মাংসপিণ্ড আছে। তাঁর কটি পিপীলিকার মধ্যভাগের ন্যায় ক্ষীণ, পরিধেয় চীরবসনের ভিতরে সুবর্ণমেখলা দেখা যাচ্ছিল। আমার এই জপমালার ন্যায় তার চরণে ও হস্তে শব্দকারী আশ্চর্য মালা আছে। তার পরিধেয় অতি অদ্ভুত, আমার চীরবসনের মতন নয়। তার মুখ সুন্দর, কণ্ঠস্বর কোকিলের তুল্য, তাঁর বাক্য শুনলে আনন্দ হয়। তিনি তার ডান হাত দিয়ে একটি গোলাকার ফলকে বার বার আঘাত করছিলেন, সেই ফলটি ভূমি থেকে লাফিয়ে উঠছিল। সেই দেবপুত্রের উপর আমার অত্যন্ত অনুরাগ হয়েছে, তিনি আমাকে আলিঙ্গন করে আমার জটা ধরে মুখে ঠেকিয়ে একপ্রকার শব্দ করলেন, তাতে আমার হর্ষ হল। তিনি যেসব ফল আমাকে খেতে দিয়েছিলেন তার ত্বক আর বীজ নেই, আমাদের আশ্রমের ফল তেমন নয়। তার প্রদত্ত সুস্বাদু জল পান করে আমার অত্যন্ত আনন্দ হল , বোধ হল যেন পৃথিবী ঘুরছে। এইসকল বিচিত্র সুগন্ধ মালা তিনি ফেলে গেছেন, তার বিরহে আমি অসুখী হয়েছি, আমার গাত্র যেন দগ্ধ হচ্ছে। পিতা, আমি তার কাছে যেতে চাই, তার ব্রহ্মচর্য কি প্রকার ? আমি তার সঙ্গেই তপস্যা করব।
বিভান্ডক বললেন, ওরা রাক্ষস, অদ্ভুত রূপ ধারণ করে তপস্যার বিঘ্ন জন্মায়, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করাও তপস্বীদের উচিত নয়। পুত্র, অসৎ লোকেই সুরাপান করে, মুনিদের তা পান করা অনুচিত, আর এই সকল মাল্যও আমাদের অব্যবহার্য।
ওরা রাক্ষস, এই বলে পুত্রকে নিবারণ করে বিভাণ্ডক বেশ্যাকে খুঁজতে গেলেন, কিন্তু তিন দিনেও না পেয়ে আশ্রমে ফিরে এলেন। তারপর যখন তিনি ফল আহরণ করতে গেলেন তখন বেশ্যাকন্যা আবার আশ্রমে এল। ঋষ্যশৃঙ্গ হৃষ্ট ও ব্যস্ত হয়ে তাকে বললেন, আমার পিতা ফিরে আসবার আগেই আমরা আপনার আশ্রমে যাই চলুন। বেশ্যা তাকে নৌকায় নিয়ে গেল এবং বিবিধ উপায়ে তাকে প্রলোভিত করে অঙ্গদেশের অভিমুখে যাত্রা করলে। নৌকা যেখানে উপস্থিত হল তার তীরদেশে লোমপাদ এক বিচিত্র আশ্রম নির্মাণ করলেন। রাজা ঋষ্যশৃঙ্গকে অন্তঃপুরে নিয়ে যাওয়ামাত্র দেবরাজ প্রচুর বৃষ্টিপাত করলেন। অঙ্গরাজের কামনা পূর্ণ হল তিনি তাঁর কন্যা শান্তাকে ঋষ্যশৃঙ্গের হস্তে সম্প্রদান করলেন।
বিভান্ডক আশ্রমে ফিরে এসে পুত্রকে দেখতে না পেয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। লোমপাদের আজ্ঞায় এই কার্য হয়েছে এইরূপ অনুমান করে তিনি অঙ্গরাজধানী চম্পার অভিমুখে যাত্রা করলেন। শ্রান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে তিনি এক গোপপল্লীতে এলে গোপগণ তাকে যথোচিত সৎকার করলে, বিভাণ্ডক রাজার ন্যায় সুখে রাত্রিবাস করলেন। তিনি তুষ্ট হয়ে প্রশ্ন করলেন, গোপগণ, তোমরা কার প্রজা? লোমপাদের শিক্ষা অনুসারে তারা কৃতাঞ্জলি হয়ে উত্তর দিলে, মহর্ষি, এইসব পশু ও কৃষিক্ষেত্র আপনার পুত্রের অধিকারভুক্ত। এইরূপে সম্মান পেয়ে এবং মিষ্ট বাক্য শুনে বিভাণ্ডকের ক্রোধ দূর হল তিনি রাজধানীতে এসে লোমপাদ কর্তৃক পূজিত হয়ে এবং পুত্র-পুত্রবধূকে দেখে তুষ্ট হলেন। বিভাণ্ডকের আজ্ঞায় ঋষ্যশৃঙ্গ কিছুকাল অঙ্গরাজ্যে রইলেন এবং পুত্রজন্মের পর আবার পিতার আশ্রমে ফিরে গেলেন। । ।
https://slotbet.online/