Email : esaharanews@gmail.com
  • অন্যান্য
নোটিফিকেশন
আজকের সর্বশেষ সবখবর

আঠারো শতকের বাংলার শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

ESARA NEWS
সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ ১:২৫ অপরাহ্ণ । ৬৫ জন
Link Copied!

জাহাঙ্গীর আলম : ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দের এ্যাডাম রিপোর্টে বাংলা ও বিহারের এক লক্ষেরও বেশি স্কুলের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৮০২ খৃষ্টাব্দে বর্ধমানের ম্যাজিস্ট্রেট একটি সরকারি প্রতিবেদনে তাঁর জেলার গ্রামগুলিতে স্কুল আছে বলে জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে সেই সময়ে বর্ধমান জেলায় এমন কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রাম ছিল না, যেখানে একটিও স্কুল ছিল না। (বর্ধমান ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ার, জে. সি. কে. পিটারসন, ১৯১০ সাল, পৃ: ১৭২-১৭৪) গবেষকদের মতে পলাশীর যুদ্ধের মাত্র পয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না। কারণ, ১৮১৩ খৃষ্টাব্দের চার্টার এ্যাক্টের আগে শিক্ষাখাতে ব্যবহার করবার জন্য ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কাছে কোনো ব্যয় বরাদ্দ ছিল না। এর আগে কলকাতা ও কলকাতার আশেপাশে বেসরকারী উদ্যোগে যেসমস্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে উঠেছিল, সেগুলোর সবই ইংরেজি শেখানোর স্কুল ছিল।
ঐতিহাসিকদের মতে নবাবী আমলেই বঙ্গদেশে গ্রামীন পাঠশালা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের আগে বাংলার গ্রামগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণে স্কুল ছিল। গোলাম হোসেন সলিম ও সৈয়দ গোলাম হোসেন, উভয়েই তাঁদের লেখায় নবাব মুর্শিদকুলী, সুজাউদ্দিন ও আলিবর্দীকে বিদ্যানুরাগী, এবং বিদ্বান, ধর্মজ্ঞ, চিকিৎসক ও পণ্ডিতব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষক বলে উল্লেখ করেছিলেন। (রিয়াজ-উস-সালাতীন, গোলাম হোসেন সলিম, পৃ: ২৮১-২৯৯; সিয়ার-উল-মুতাক্ষরীণ, সৈয়দ গোলাম হোসেন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ৬৯-৭০) নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ভোজসভার আয়োজন করে সেখানে পণ্ডিত ও বিদ্বান ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে আপ্যায়িত করতেন। নবাব সুজাউদ্দিনও নিয়ম করে তাঁর বার্ষিক ভোজসভায় রাষ্ট্রের বিদ্বান ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে উৎসাহিত করতেন। ১৭৪৮ খৃষ্টাব্দে বিহারে আফগান বিদ্রোহ দমন করবার পরে নবাব আলিবর্দী পাটনাতে সমবেত পারস্যাগত সমুদয় বিদ্বান ব্যক্তিকে মুর্শিদাবাদে গিয়ে বাস করবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নবাব সরকারের তহবিল থেকে তাঁদের পেনসন দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। মুর্শিদাবাদ বাংলার রাজধানী হিসাবে পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে, হুগলী বাংলার একটি প্রধান শিয়া উপনিবেশ হিসাবে গড়ে উঠেছিল। সেখানে তখন শিয়া ধর্মশাস্ত্র, ইসলামী চিকিৎসাবিদ্যা ও পারসীক সংস্কৃতির চর্চা হত। সেখানে অনেক পারস্যবাসী অধ্যাপক, চিকিৎসক ও পণ্ডিত ব্যক্তির সমাবেশ ঘটেছিল। আলোচ্য সময়ে শুধু হুগলীই বাংলার সমৃদ্ধ বন্দর ছিল না, আশপাশের অঞ্চলগুলিও তখন বেশ সমৃদ্ধ ছিল। ওই অঞ্চলে শিক্ষক ও চিকিৎসকের চাহিদা ভালই ছিল। ঐতিহাসিক আবুল হাসান গুলিস্তানি (নাদির শাহের ইতিহাসের স্রষ্টা) এখানে গিয়েছিলেন। তাঁর পিতৃব্যও সেই সময়ে বঙ্গদেশে ছিলেন। (হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল, যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, দ্বিতীয় খণ্ড, একুশতম অধ্যায় দ্রষ্টব্যঃ)
আলোচ্য যুগে বাংলার নবাব, অভিজাত ব্যক্তি, এবং শক্তিশালী ধনী জমিদারেরা বঙ্গদেশের শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য তাঁরা নিষ্কর ভূমি দান করতেন। তাছাড়া ওই সময়ে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে মাসিক বা বাৎসরিক স্টাইপেণ্ড ও খরচ দেওয়ার নিয়ম চালু ছিল। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেযুগের তেমনি একজন শিক্ষানুরাগী পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর শিক্ষা সম্পর্কিত উৎসাহ ও বদান্যতা শুধু তাঁর জমিদারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, নদীয়ার বাইরে সুদূর বিক্রমপুর ও বাকলার পণ্ডিতেরাও তাঁর অর্থানুকূল্য লাভ করেছিলেন। তিনি তাঁর নিজের জমিদারির মধ্যে সংস্কৃত চতুষ্পাঠী ও টোল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য তিনি প্রচুর নিষ্কর ভূসম্পত্তি দান করেছিলেন। এছাড়া তিনি প্রতি মাসে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে নবদ্বীপে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে আগত বিদেশী ছাত্রদের জন্য অন্ততঃ দু’শ টাকা মাসোহারা হিসাবে ব্যয় করতেন। সমকালীন বর্ধমানের রাজা কীর্তিচাঁদ ও তিলকচাঁদ, বীরভূমের আসাদুল্লাহ ও বদিউজ্জামান খানের পরিবার, নাটোরের রামকান্ত ও তাঁর স্ত্রী রাণী ভবানী, বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা গোপাল সিংহ ও চৈতন্যসিংহ, এবং ঢাকার রাজনগরের দেওয়ান রাজবল্লভ সেনও বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তাঁরা সকলেই তাঁদের জমিদারির আয়ের একটা অংশ বিদ্বান, পণ্ডিতব্যক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য ব্যয় করতেন। সেকালে বাংলার জমিদারেরা শিক্ষাক্ষেত্রে শুধু অর্থ ব্যয় করেই ক্ষান্ত হতেন না। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলি ভালোভাবে পরিচালনা করবার জন্যও তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহ দেখাতেন। তাঁরা শিক্ষক এবং ছাত্রদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও উন্নতির খোঁজখবরও নিতেন। (ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত, কার্তিকেয়চন্দ্র রায়, পৃ: ৩৯-৪৪, হিস্ট্রি অফ বিষ্ণুপুররাজ, এ. পি. মল্লিক, পৃ: ১১৫-১১৭)
একথা বলাই বাহুল্য যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে এখনকার মত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কোনো সুশৃঙ্খল ও সুগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না। সেযুগে বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগে – নবাব, অভিজাত ব্যক্তি ও জমিদারদের উৎসাহ এবং পৃষ্ঠপোষকতার ওপরে নির্ভর করেই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। সেই ব্যবস্থাকে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে – (১) হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের জন্য মিশ্র প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা – পাঠশালা ও তোলবাখানা; (২) মুসলমান ছাত্রদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা – মক্তব ও মাদ্রাসা; এবং (৩) হিন্দু ছাত্রদের জন্য সংস্কৃত শিক্ষার ব্যবস্থা – চতুষ্পাঠী ও টোল। আঠারো শতকের বঙ্গদেশে হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য গ্রামে পাঠশালা ও তোলবাখানা ছিল। ওই ধরণের প্রতিষ্ঠানগুলিতে তখন হিন্দু ও মুসলমান ঘরের বালকেরা নিজেদের পড়াশোনা শুরু করতেন। তখনকার শতকরা আশিভাগ বা ততোধিক ছাত্রের শিক্ষার সমাপ্তিও সেখানেই ঘটত। আলোচ্য সময়ে সাধারণতঃ পাঁচ বছর বয়সে গ্রাম্য পাঠশালায় গুরু মহাশয়ের অধীনে বাঙালী শিক্ষার্থীরা তাঁদের পাঠ শুরু করতেন, এবং দশ-এগারো বছর বয়সে তাঁদের সেই শিক্ষার সমাপ্তি ঘটত। সেকালের হিন্দু ঘরের কন্যারাও গ্রাম্য পাঠশালায় এক বা দু’ বছর ধরে পড়াশোনা করতেন, কিন্তু আট বছর বয়স পূর্ণ হলেই অভিভাবকেরা তাঁদের আর পাঠশালায় পাঠাতেন না। তবে তখনকার মুসলমান ঘরের বালিকারা ওই ধরণের গ্রাম্য পাঠশালায় পড়তে যেতেন না। সেকালের অভিজাত মুসলমানেরা তাঁদের নিজেদের গৃহেই গৃহশিক্ষকের কাছে কন্যাদের পাঠের ব্যবস্থা করতেন। তিন-চারটি পাশাপাশি গ্রামের ছাত্রদের নিয়ে সেযুগে এক একটি গ্রামীণ পাঠশালা গড়ে উঠত। সাধারণতঃ ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ বর্ণের কোনো ব্যক্তিই সেকালের গ্রামের পাঠশালায় গুরুগিরির দায়িত্ব নিতেন। (স্কেচেস অব দি হিন্দুস, ব্রুফার্ড, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ১২-১৩) ছাত্ররা কড়ি দিয়ে তাঁদের গুরু মহাশয়ের বেতন দিতেন, এবং ফসল ওঠবার সময়ে গুরু মহাশয় শিক্ষকতার দক্ষিণা হিসাবে সেই ফসলের একটা সামান্য অংশ পেতেন। গ্রামের জমিদারের চণ্ডীমণ্ডপ, নাটমন্দির বা গুরু মহাশয়ের কুটিরে তখনকার পাঠশালাগুলি বসত। সেখানে চাটাই বা মাদুরে ছাত্রদের বসবার ব্যবস্থা করা হত। তাছাড়া আবহাওয়া ভাল থাকলে কোন গাছতলাতেও পাঠশালা বসত। গুরু মহাশয় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ছাত্রদের সামান্য অঙ্ক শেখাতেন। তখন অঙ্ক না শিখলে কোনো কাজ চলত না। ওই যুগে সাধারণ বাঙালী ঘরের মানুষকেও চাষবাসের হিসাব, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারির আয়-ব্যয় ও রাজস্বের হিসাব রাখতেই হত। তাই তখন সামাজিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে ছাত্রদের প্রাথমিক অঙ্ক শেখানো হত। ইতিহাস বলে যে, বঙ্গদেশে মুখে মুখে অঙ্ক শেখানোর রীতি কিন্তু শুভঙ্করের (ভৃগুরাম দাস) আগে থেকেই চালু ছিল। পরবর্তী সময়ে শুভঙ্কর তাঁর অতি পরিচিত মানসাঙ্কের ছড়াগুলিতে সেই রীতিকে আরো সুন্দরভাবে একটা সুগঠিত রূপ দিয়েছিলেন। সেই মানসাঙ্কের ছড়াগুলি তখনকার ছাত্রদের কণ্ঠস্থ করতে হত। এছাড়া আরো দুটি জিনিস সেকালের পাঠশালায় ছাত্রদের শেখানো হত; সেগুলি হল – অক্ষর পরিচিতি, এবং পড়া ও লেখা। বলাই বাহুল্য যে, সেই সময়ে পড়বার জন্য কোন মুদ্রিত বই, বা লেখবার জন্য শ্লেট জাতীয় কিছু ছিল না। তখনকার ছাত্ররা তাল বা কলার পাতাকে লেখবার জন্য ব্যবহার করতেন। এছাড়া মাটিতে বালি ছড়িয়ে সেটার উপরে আঙুল দিয়ে লেখবার প্রথাও চালু ছিল, এমনকি মাটিতেও তখন খড়ি দিয়ে লেখা হত। ঠিক একই পদ্ধতিতে তখন ছাত্রদের বর্ণ পরিচয় করানো হত। সেকালের পাঠশালায় কোনো বই পড়ানো হত না, শুধু দু’-চারটি ছড়া ও কবিতা মুখে মুখে শেখানো হত। অনেক সময় পাথরের নুড়ি ও ঝিনুক দিয়ে অঙ্ক শেখানো হত। (স্কেচেস অব দি হিন্দুস, ব্রুফার্ড, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ১২-১৩; হিস্ট্রি অফ হিন্দুস, ওয়ার্ড, প্রথম খণ্ড, পৃ- ১১৯) অল্প পড়া, চিঠি লেখা ও অঙ্ক কষা – এই তিনটিই সে যুগের বাংলার পাঠশালা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল। ছাত্ররা সেগুলি আয়ত্ত্ব করতে পারলেই তাঁদের গুরু মহাশয়রা খুশি হতেন। আলোচ্য সময়ের ইতিহাস থেকে বঙ্গদেশে পাঠশালা ছাড়াও তখনকার আরো এক ধরণের মিশ্র প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় পাওয়া যায়। সেটার নাম ছিল তোলবাখানা। (টিপিক্যাল সিলেকশনস ফ্রম ওল্ড বেঙ্গলি লিটারেচার, দীনেশচন্দ্র সেন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ- ১৮৫৪) শমশের গাজীর পুঁথিতে ওই ধরণের বিদ্যালয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। শমশের গাজী আরবী, ফারসী এবং বাংলা শেখানোর জন্য নিজের কাছে ১০০ জন ছাত্রকে রেখেছিলেন। তিনি সেই ছাত্রদের পড়ানোর জন্য হিন্দুস্তান (উত্তর ও মধ্যে ভারত) থেকে আরবী ভাষার শিক্ষক, ঢাকার কাছে অবস্থিত জগদিয়া থেকে বাংলা ভাষার পণ্ডিত, এবং ঢাকা থেকে ফারসী ভাষা পড়ানোর জন্য মুন্সীকে নিয়ে এসেছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বালকেরাই তাঁর পাঠশালায় পড়াশোনা করতেন। ওই ভাবে পাঠশালা ও তোলবাখানার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা তখন সারা বঙ্গদেশে জুড়েই চালু ছিল। সেখানে শিক্ষা নিয়েই তখনকার বেশিরভাগ বাঙালী ঘরের সন্তানেরা তাঁদের শিক্ষা শেষ করতেন। তখনকার সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাগতিক কাজকর্ম সম্পাদনে, এবং সহজ, সরল গ্রাম্যজীবন যাপন করতে তাঁদের কোন ধরণের অসুবিধা কিন্তু হত না। অবশ্য যেটুকু শিক্ষা তাঁরা পাঠশালায় পেতেন, সারা জীবন ধরে সেটার চর্চা চালু থাকত। বাড়িতে বাড়িতে বাংলা রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত পুরাণের বাংলা অনুবাদ পাঠ; এবং কথকতা, পাঁচালী, পল্লীগাথা ও গীতিকাব্য শোনা, সে যুগের বাঙালীর মননশীলতার একটা অঙ্গ ছিল। সেগুলির মধ্যে দিয়েই তখন বাঙালীর মন ও মানসিকতা গড়ে উঠত। তখনকার একদল ভ্রাম্যমান শিক্ষক তাতে পুষ্টি যোগাতেন। তাঁরা ছিলেন – সূফী, দরবেশ, ফকির, ব্রাহ্মণ ঠাকুর, বৈষ্ণব সহজিয়া, আউল, বাউল, কর্তাভজা প্রভৃতি। তাঁরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বংলার আপামর জনসাধারণকে ধর্ম, নৈতিকতা, ইহলোক ও পরলোক সম্বন্ধে নানা রকমের উপদেশ দিতেন। ধর্মশাস্ত্রের তত্ত্ব ও অনুশাসনগুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে তাঁরা সহজভাবে ব্যাখ্যা করতেন। একেশ্বরবাদ, বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ও ন্যায়ের পক্ষে তাঁরা প্রচার চালাতেন। তাই সেকালের বাঙালীর মানসলোক গঠনের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রভাবকে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। এখন একথা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, আলোচ্য যুগের বেশিরভাগ বাঙালী নিরক্ষর হলেও অজ্ঞ কিন্তু ছিলেন না।
আঠারো শতকের বাংলার নবাব, অভিজাত, আমির ও ধনী মুসলমানদের বদান্যতায়, এবং অর্থানুকূল্যে মক্তব ও মাদ্রাসাকে ঘিরে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। তখন অবিভক্ত বাংলার মধ্য ও পূর্বাঞ্চল মূলতঃ মুসলমান প্রধান, এবং পশ্চিমাঞ্চল মূলতঃ হিন্দুপ্রধান ছিল। কয়েকটি মুসলমান প্রধান গ্রাম নিয়ে সেকালের মুসলমান বালকদের পঠন পাঠনের জন্য একটি মক্তব পরিচালিত হত। সেখানকার শিক্ষকেরা ‘আখুনজী’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাঙালী মুসলমান ঘরের বালকদের আরবী, উর্দু ও ফারসী বর্ণমালা শেখানো; সেগুলো লিখতে শেখানো, মুখে মুখে আরবী ও ফার্সী সাহিত্য থেকে পড়ানো, প্রাথমিক অঙ্ক শেখানো, এবং ইসলামী ধর্ম শাস্ত্রের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় করে দেওয়াই তাঁদের কাজ ছিল। মক্তবের বালকেরা তাল ও কলাপাতা ছাড়াও লেখবার জন্য দেশী কাগজ ব্যবহার করতেন। মক্তবগুলিতে খাগ ও কণ্ডির কলম এবং দেশী কালি ব্যবহার করা হত। সেযুগের বেশির ভাগ ছাত্রই পাঠশালা ও মক্তবে শিক্ষা শেষ করে চাষবাস ও নিজের নিজের পারিবারিক বৃত্তিতে যোগ দিতেন। তবে তাঁদের মধ্যে যাঁরা মেধাবী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তাঁরা উচ্চতর শিক্ষার জন্য মাদ্রাসাগুলিতে গিয়ে হাজির হতেন। সে যুগের মাদ্রাসাগুলি সাধারণত মসজিদ ও ইমামবাড়ার সঙ্গে যুক্ত থাকত। তৎকালীন বাংলার রাজধানীতে, প্রধান শহরগুলিতে, এবং জেলা শহরে সেই মাদ্রাসাগুলি ছিল; নবাব সরকার সেগুলির পঠন পাঠন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করত। সেগুলির জন্য অনেক নিষ্কর ভূমিও নির্দিষ্ট করা ছিল। তাছাড়া রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে মাদ্রাসাগুলোর জন্য মাসিক বা বাৎসরিক অর্থ বরাদ্দ তো ছিলই। ছাত্ররা সেই মাদ্রাসাগুলিতে বিনা খরচায় আহার ও বাসস্থান পেতেন, এবং বিনা বেতনে সেখানে পড়াশোনা করতে পারতেন। মুসলিম শাস্ত্রের পণ্ডিত, মৌলভি এবং বিদ্বান ব্যক্তিরা সেখানে শিক্ষকতা করতেন। সেখান থেকে পাশ করবার পরে ছাত্ররা শিক্ষকতায় যোগ দিতেন অথবা বিচার বিভাগে চাকরি পেতেন। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব শিক্ষিত ব্যক্তিদের বিচার বিভাগে নিযুক্ত করবার ব্যবস্থা করেছিলেন। তখনকার মাদ্রাসাগুলিতে ছাত্রদের ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্র (কোরাণ, হাদিস ইত্যাদি), আইন (সরাহ), আরবী ও ফারসী সাহিত্য, এবং আরব দেশের বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্র শেখানো হত।
আঠারো শতকের বাংলার ধনী হিন্দু জমিদারেরা বঙ্গদেশে সংস্কৃত শিক্ষার ধারক ও বাহক ছিলেন। তাঁরা সকলেই তাঁদের নিজেদের জমিদারিতে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য চতুষ্পাঠী ও টোল স্থাপন করেছিলেন। সেই চতুষ্পাঠী ও টোলগুলিতে ছাত্ররা শিক্ষকদের সঙ্গেই বাস করতেন। সেখানকার শিক্ষকেরা ছাত্রদের আহার, বাসস্থান ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। জমিদারদের দানে সেগুলির ব্যয় নির্বাহ হত। তখনকার শিক্ষকদের প্রয়োজনও অবশ্য খুব কম ছিল। তখনকার বাংলার ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, শাস্ত্রচর্চা ও গ্রন্থ রচনার কাজে নিযুক্ত থাকতেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আবার জাগতিক সুখ-দুঃখ ও অন্যান্য ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। সেযুগের হিন্দু ঘরের বালকদের পাঁচ বছর বয়সে চতুষ্পাঠীতে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষারম্ভ হত। প্রথমে ছাত্রদের বর্ণ শিক্ষা দেওয়া হত। তারপরে ধীরে ধীরে তাঁদের ব্যাকরণ, কাব্য, অলংকার, ন্যায়, স্মৃতি, জ্যোতিষ, দর্শনের বিভিন্ন শাখা, বেদান্ত ও বৈদিক ছন্দ শেখানে৷ হত। আলোচ্য সময়ে বঙ্গদেশের বহু শহর ও গ্রামে চতুষ্পাঠী ছিল। রামপ্রসাদ সেন তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যে বর্ধমানের একটি চতুষ্পাঠীর বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেকালের বর্ধমানে সংস্কৃত শিক্ষা করবার জন্য দ্রাবিড়, উৎকল, কাশী ও মিথিলা থেকে ছাত্ররা আসতেন। (রামপ্রসাদ সেন গ্রন্থাবলী, বিদ্যাসুন্দর, বসুমতী সংস্করণ, পৃ: ৫০-৫১) চতুষ্পাঠীর শিক্ষান্তে মেধাবী ও উচ্চাভিলাষী ছাত্ররা সংস্কৃত শিক্ষার জন্য উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে যেতেন। তখন সংস্কৃত শিক্ষার জন্য উচ্চতর প্রতিষ্ঠান ছিল টোল। অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার অক্সফোর্ড নবদ্বীপ ছাড়াও তখন ২৪ পরগণার ভাটপাড়া, গুপ্তিপাড়া, বর্ধমান, ত্রিবেণী, হাওড়ার বালী, ঢাকার রাজনগর ও বিষ্ণুপুর প্রভৃতি জায়গায় সংস্কৃত শিক্ষার টোল ছিল। সেখানে ছাত্রদের সংস্কৃত নিয়ে উচ্চতর বিষয়ে পড়াশুনা করবার সুযোগ থাকত। সেকালের ছাত্ররা ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করবার জন্য নবদ্বীপে যেতেন। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর নৈয়ায়িক পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণি সেই ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তখনকার বাংলার টোলগুলিতে ন্যায়শাস্ত্র ছাড়াও ব্যাকরণ, স্মৃতি (আইন), কাব্য, দর্শন, জ্যোতিষ, বেদ, পুরাণ ও অভিধান পড়ানো হত। সেযুগের ছাত্ররা সাধারণতঃ কোনো একটি বিষয় নিয়ে আট থেকে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশুনা করতেন। তখন বঙ্গদেশে পাঠ শেষ করে অনেক ছাত্র দর্শন ও স্মৃতিতে আরো উচ্চতর পাঠের জন্য যেমন মিথিলায় (দ্বারভাঙ্গা) যেতেন, তেমনি ব্যাকরণ, অলংকার এবং বেদে আরো উচ্চতর জ্ঞানার্জনের জন্য কাশীতে যেতেন। উচ্চতম পাঠ শেষে সেই সব ছাত্ররা তাঁদের নিজেদের গ্রামে বা শহরে ফিরে চতুষ্পাঠী ও টোল খুলে ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন।
আলোচ্য যুগে স্ত্রীজাতির শিক্ষার জন্য কোনো আলাদা প্রতিষ্ঠান ছিল না। তখনকার হিন্দু ঘরের বালিকারা আট বছর বয়স পর্যন্ত বালকদের সঙ্গেই পাঠশালায় পড়তেন। তবে সেকালের বাংলার মুসলিম সমাজ সেই ব্যাপারে আরো বেশি গোঁড়া ও রক্ষণশীল ছিলেন। মুসলিমদের মধ্যে ধনীরা নিজেদের বাড়িতে গৃহ শিক্ষক রেখে তাঁদের কন্যাদের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু তখনকার দরিদ্র মুসলমান পরিবারের বালিকাদের লেখাপড়া শেখা হত না। তখনকার ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ ঘরের মহিলাদের অনেকেই নিজেদের বাড়িতে লেখাপড়া শিখে নিতেন। সেযুগে মহিলাদের পড়াশোনা করাটা অনেকটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগের ব্যাপার ছিল। রাষ্ট্রের বা জমিদারদের সেই ব্যাপারে কোনো দায় দায়িত্ব ছিল না। নারীজাতির শিক্ষা সম্পর্কিত মনোভাব থেকে সে যুগের মানুষের নারীজাতি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিটাও পরিষ্কার হয়ে যায়। তখনকার সমাজ নেতারা চাননি যে, মহিলারা প্রশাসনে, রাষ্ট্র পরিচালনায় বা বিচার বিভাগে উচ্চপদ গ্রহণ করুন। তাঁরা চেয়েছিলেন যে, মহিলারা গৃহকর্ত্রী গৃহরক্ষা করুন। গৃহই তখনকার মহিলাদের প্রধান কর্মক্ষেত্র বলে বিবেচিত হত। কিন্তু তৎকালীন সমাজ নেতাদের ওরকম মনোভাব সত্ত্বেও সেযুগের ইতিহাসে কয়েকজন অসাধারণ বিদুষী ও বুদ্ধিমতী মহিলার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদের বিদ্যাসুন্দরের নায়িকা বিদ্যা অসাধারণ বিদূষী ছিলেন। ‘হরিলীলা’ গ্রন্থের কবি জয়নারায়ণ সেনের আত্মীয়া – আনন্দময়ী, দয়াময়ী ও গঙ্গামণি – সকলেই বিদূষী ও অল্পবিস্তর কবিখ্যাতি সম্পন্না ছিলেন। দেওয়ান রাজবল্লভ সেন বৈদ্যদের যজ্ঞোপবীত ধারণ উপলক্ষ্যে যে যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন, আনন্দময়ী অথর্ববেদ ঘেঁটে সেই যজ্ঞের বেদি তৈরি করে দিয়েছিলেন। এ থেকে মনে হয় যে, সে যুগের উচ্চবংশীয় হিন্দু ঘরের মহিলারা সংস্কৃত ভাষা জানতেন। (বৃহৎ বঙ্গ, দীনেশচন্দ্র সেন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ৯১০-৯১২) সমকালীন নাটোরের রাণী ভবানীও বিদূষী ছিলেন। নিজের বিশাল জমিদারির হিসাবপত্র তিনি নিজে তদারকি করতেন। সেকালের বাংলার অভিজাত বংশীয় মুসলমান রমনীরাও শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না। গোলাম হোসেন তাঁর লেখায় নবাব আলিবর্দীর বেগমের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে তিনি তাঁর স্বামীর পাশে পাশে ছিলেন। রাষ্ট্রনীতি ও সামরিক বিষয়ে তিনি তাঁর স্বামীকে সুপরামর্শ দিতেন। তিনি আলিবর্দীকে কখনো কোন অন্যায় কাজ করতে পরামর্শ দেননি। আলিবর্দীও তাঁর মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। মুর্শিদকুলীর বেগমও একজন মহীয়সী মহিলা ছিলেন। সেই মহিলা তাঁর একক চেষ্টায় জামাতা সুজাউদ্দিন ও দৌহিত্র সরফরাজ খানের মধ্যেকার বিরোধ মিটিয়ে দিয়ে বাংলাকে একটি গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। সুজাউদ্দিনের কন্যা দরদানা বেগম (দ্বিতীয় মুর্শিদকুলীর স্ত্রী), সরফরাজ খানের মা জিন্নাতুন্নেসা বেগম ও ভগিনী নাফিসা বেগম – সে যুগের মুসলিম অভিজাত মহিলাদের মধ্যে বিদূষী ও বুদ্ধিমতী বলে খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিলেন। (বেগমস অব বেঙ্গল, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)
ফারসী সে যুগের দরবারি ভাষা ছিল। তাই তখনকার হিন্দু ও মুসলমান অভিজাত ও জমিদারেরা সকলেই ফারসী ভাষা শিখতেন। তাছাড়া সেকালের শিক্ষিত বাঙালীরা সকলেই রাজকার্য্য পাওয়ার আশায় ফারসী ভাষা শিখতেন। ওই যুগের সবচেয়ে বড় দু’জন বাঙালী কবি – ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদ – ফারসী শিখেছিলেন। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসী শিক্ষক রাজা নবকৃষ্ণ, এবং ধর্মমঙ্গলের কবি নরসিংহ বসুও ভাল ফারসী জানতেন। তৎকালীন বিহারের ডেপুটি গভর্ণর রামনারায়ণ ফারসী ও উর্দুতে কবিতা লিখতেন। গোলাম হোসেন আলম তাঁর লেখায় চাঁদের পুত্র কাইরেত চাঁদের ফারসী জ্ঞানের প্রশংসা করেছিলেন। আলোচ্য সময়ে বাংলার নবাবেরা বাঙালী হিন্দুদের বিপুল সংখ্যায় প্রশাসনিক কাজকর্মে নিযুক্ত করেছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের তখনকার প্রশাসনিক ভাষা শিখতে হয়েছিল। তবে প্রয়োজন ছাড়াও সেযুগের পণ্ডিত ও বিদ্বান বাঙালীরা ফারসী ভাষা শিখতেন। আসলে ফারসী ভাষা সেযুগের বঙ্গসংস্কৃতির একটা অঙ্গ ছিল। আলোচ্য যুগের উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদের শিক্ষার স্বরূপ সম্পর্কে ল্যুক স্ক্র্যাফটনের গ্রন্থে আভাস পাওয়া যায়। (রিফ্লেকশনস, ল্যুক স্ক্র্যাফটন, পৃ- ১৯) তাঁদের শিক্ষার তিনটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল – (১) আরবী ও ফারসী লিখতে ও পড়তে শেখা, (২) গাম্ভীর্য ও বিচক্ষণতা অর্জন করা, এবং সেই সঙ্গে আবেগ ও অধৈর্য্যভাব দমন করা, (৩) অশ্বারোহন ও অস্ত্রচালনা শিক্ষা করা। তখনকার হিন্দু অভিজাত ও জমিদারদের শিক্ষার ধরণটিও অনেকটা একই রকমের ছিল। তাঁরা সকলেই কম বেশি ফারসী শিখতেন, একই সাথে বাংলা পড়তে ও লিখতে শিখতেন, আর সেই সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করবার জন্য তাঁদের সামান্য অঙ্কের জ্ঞান দরকার হত। তৎকালীন বাংলার হিন্দু জমিদারেরা সকলেই অশ্বারোহন এবং অস্ত্রচালনা শিখতেন। অনেকেই তখন সে বিষয়ে কৃতবিদ্য হয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা রঘুরাম ধনুর্বিদ্যা ও অস্ত্র চালনায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন।
গোলাম হোসেন তাঁর গ্রন্থে আলিবর্দীর দরবারের বিদগ্ধ ব্যক্তিদের একটি তালিকা দিয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন – ইসলামী শাস্ত্রে সুপণ্ডিত মৌলভি নাসের, দাউদ আলি খাঁ (ইনি জাহির হোসেন খাঁ নামে সেকালে অধিক পরিচিত ছিলেন), কবি মির্জা মোয়েজ মুসেবি খাঁয়ের শিষ্য মির মাহমেদ আলিম, ইসলামী শাস্ত্রজ্ঞ মৌলভি মোহাম্মদ আরিফ, মির রুস্তম আলি, কোরাণে সুপণ্ডিত শাহ মাহমেদ আমিন, শাহ আধেম, হায়াত বেগ, বিখ্যাত ধর্মজ্ঞ শাহ খিজির, গুণী ও ধর্মপ্রাণ সৈয়দ মীর মাহমেদ সাজ্জাদ, ইতিহাসবিদ গোলাম হোসেনের পিতামহ সৈয়দ আলিমুল্লাহ এবং শাহ হায়দারি। আলিবর্দী পাটনার বিখ্যাত পণ্ডিত কাজী গোলাম মজফ্ফরকে মুর্শিদাবাদের প্রধান বিচারকের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। (সিয়ার-উল-মুতাক্ষরীণ, সৈয়দ গোলাম হোসেন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ১৬৫-১৭৫) নবাব সুজাউদ্দিনের সময়ে হাদি আলি খাঁ তাঁর দরবারের চিকিৎসকরূপে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি, এবং তাঁর পরিবার চিকিৎসা বিদ্যা, পাণ্ডিত্য ও শাস্ত্র জ্ঞানের জন্য সেযুগের মুর্শিদাবাদে অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন। আলিবর্দী হাদি আলিকে বার্ষিক ১৪,০০০ টাকা বেতন দিতেন। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র মোহাম্মদ হোসেন খাঁও একজন সুপণ্ডিত ও সুচিকিৎসক ছিলেন। হাদি আলির ভাই আলি খাঁ নাকি সম্রাট মহম্মদ শাহের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। উল্লেখ্য যে, এই পরিবারেই মোহাম্মদ রেজা খাঁ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তিনি হাদি আলির তৃতীয় পুত্র ছিলেন। (দি ট্রানজিশন ইন বেঙ্গল, আবদুল মজিদ খাঁ, পৃ: ১৭-১৮)
অষ্টাদশ শতকে কৃষ্ণচন্দ্রের নদীয়া জেলা বাংলার হিন্দু শিক্ষা ও সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় কেন্দ্ৰ ছিল। তখনকার অপর দুটি কেন্দ্র ছিল – বর্ধমান ও রাজনগর (ঢাকা)। কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে (১৭১০-১৭৮২) নদীয়াতে বিবিধ বিদ্যাবিশারদ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল। সে যুগের নবদ্বীপে ন্যায়শাস্ত্রের পণ্ডিতদের মধ্যে – হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, রামগোপাল সার্বভৌম, এবং প্রাণনাথ ন্যায়পঞ্চানন – প্রধান ছিলেন। তখন ধর্মশাস্ত্রের পণ্ডিতদের মধ্যে – গোপাল ন্যায়ালঙ্কার, রামানন্দ বাচস্পতি, এবং বীরেশ্বর ন্যায়পঞ্চানন – বিখ্যাত ছিলেন। আলোচ্য সময়ে দর্শনশাস্ত্রে – শিবরাম বাচস্পতি, রমাবল্লভ বিদ্যাবাগীশ, রুদ্ররাম তর্কবাগীশ, শরণ তর্কালঙ্কার, মধুসূদন ন্যায়ালঙ্কার, কান্ত বিদ্যালঙ্কার এবং শঙ্কর তর্কবাগীশ – খ্যাতিলাভ করেছিলেন। গুপ্তিপাড়া গ্রামে তখন প্রসিদ্ধ কবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, ত্রিবেণীতে পণ্ডিত জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, এবং শান্তিপুরে পণ্ডিত রাধামোহন গোস্বামী ভট্টাচার্য্য বাস করতেন। জ্যোতিষশাস্ত্রে রামরূদ্র বিদ্যানিধি, এবং বাংলা কাব্যে ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদ তখন বিখ্যাত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছেই থাকতেন; অন্যদের কৃষ্ণচন্দ্র ডাকলেই তাঁরা উপস্থিত হতেন। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে তাঁদের নানাবিধ শাস্ত্রালোচনা হত। সেজন্য কবি বাণেশ্বর প্রায়ই রাজার কাছে থাকতেন। (ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত, কার্তিকেয়চন্দ্র রায়, পৃ: ১৪৬-১৪৭) তখনকার পশ্চিম বাংলায় যেমন কৃষ্ণচন্দ্র, পূর্ব বাংলায় তেমনি রাজবল্লভ সেন হিন্দুদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি রাজনগরে চতুষ্পাঠী, টোল, মক্তব এবং পাঠশালা স্থাপন করে শিক্ষার প্রসারে যত্নবান হয়েছিলেন। রাজনগরের মেধাবী ছাত্রদের তিনি নবদ্বীপে উচ্চতর সংস্কৃত শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন, যথা – নীলকণ্ঠ সার্বভৌম, কৃষ্ণদেব বিদ্যাবাগীশ এবং কৃষ্ণকান্ত সিদ্ধান্ত – কৃতী হয়ে রাজনগরে সংস্কৃত শিক্ষাদানের জন্য নিজেদের টোল খুলেছিলেন। পণ্ডিত হিসাবে তৎকালীন বঙ্গদেশে তাঁরা খুব খ্যাতিলাভ করেছিলেন।
সেযুগের রাজকাজে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হত না। তবে তখন ত্রিপুরা, কুচবিহার ও আসামে বাংলাই রাজভাষা ছিল। তবে বাংলা রাজভাষা না হলেও, তখনকার দলিল, দস্তাবেজ ও চিঠিগুলি কিন্তু বাংলা গদ্যে লেখা হত। সেকালের বৈষ্ণব সহজিয়ারা বাংলা গদ্যে তাঁদের ধর্মপুস্তিকাগুলি লিখতেন। প্রাচীন স্মৃতিগুলিও তখন বাংলা গদ্যে অনূদিত করা হয়েছিল। সেই কারণেই দেখা যায় যে, সেগুলির ভাষা সরল, এবং বাক্যগুলি জটিল নয়। তাতে অল্প কথায় ভাবপ্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও একথা বলা যেতে পারে যে, আলোচ্য সময়ে বাংলা গদ্য সাহিত্যের বাহন হয়ে উঠতে পারেনি, বা সেটা উচ্চভাব প্রকাশের ক্ষমতা পায়নি। (বৃহৎ বঙ্গ, দীনেশচন্দ্র সেন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ১১১১-১১১২) সে যুগের কবিরা সবাই ছন্দে বাংলাকাব্য, বিশেষ করে মঙ্গলকাব্য, পাঁচালী, গাথা ইত্যাদি লিখেছিলেন। তখনকার অজস্র পল্লীকবি – হায়াত মাহমুদ ও শেখ মনহর থেকে শুরু করে ফকিররাম ও ঘনরাম পর্যন্ত – বাংলা ভাষাতেই বাংলার মানুষের কাব্য পিপাসা মিটিয়েছিলেন। তখন বাঙালীর কথাবার্তায় বা লেখায় বিশুদ্ধ বাংলার ব্যবহার কম চালু ছিল। ফলে আলোচ্য সময়ের বাংলা ভাষার মধ্যে অজস্র আরবী ফারসী, হিন্দী ও উর্দু শব্দ দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি তখনকার বিদ্বান ব্যক্তিরা পর্যন্ত মিশ্র ভাষ৷ ব্যবহার করতেন। এই প্রসঙ্গে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলের’ একটি পংক্তিকে স্মরণ করা যেতে পারে – “অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল।” (ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলী, অন্নদামঙ্গল, মানসিংহ, বসুমতী সংস্করণ, পৃ- ১২১) তবে আলোচ্য সময়ের বাংলার অভিজাত মুসলমানেরা কিন্তু বাংলা ভাষায় কথা বলতেন না। তখনকার বাংলার সংস্কৃত পণ্ডিতেরাও বাংলা ভাষাকে নিতান্ত অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। তাঁরা সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার একটি অদ্ভুত মিশ্র রীতিতে লিখতেন। তাতে সংস্কৃত ভাষাই বেশি থাকত, আর বাংলা ভাষা কম থাকত। সেকালের বাংলার হিন্দু জমিদারেরা সংস্কৃত শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। মাতৃভাষার উন্নতিতে তাঁদের তেমন নজর ছিল না। আলোচ্য যুগে গুরুমহাশয়ের পাঠশালাই বাংলা ভাষা শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল। বাংলা ভাষার অগ্রগতি তখন মন্থর ছিল, এবং সংস্কৃত ভাষার অগ্রগতি তখন অপেক্ষাকৃত দ্রুত হয়েছিল।
আঠারো শতকের প্রথমার্ধেই কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষার সূত্রপাত ঘটেছিল। খৃষ্টান মিশনারীরা সেটার উদ্যোক্তা ছিলেন। তৎকালীন কলকাতার ভবঘুরে ও অনাথ বালকদের ইংরেজি শিক্ষার প্রথম মিশনারী প্রতিষ্ঠানটি ছিল – ‘ওল্ড চ্যারিটি স্কুল’। ১৭৪২ খৃষ্টাব্দে সেটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ১৭৫৪ খৃষ্টাব্দে মিশনারী ম্যাপলটফট (Mapletoft) ইংরাজী শিক্ষা প্রসারের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কলকাতা কাউন্সিলের কাছে আর্থিক সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদনে তিনি বঙ্গদেশে ইংরেজি শিক্ষার দুটি সম্ভাব্য সুফলের কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি। সে বিষয়ে তাঁর মত ছিল যে – প্রথমতঃ, বাঙালী বালকেরা ইংরেজি ও হিসাব শিখলে তাঁদের মধ্যে থেকে কোম্পানীর কর্মচারী সংগ্রহের সুবিধা হবে। দ্বিতীয়তঃ, কলকাতার ভদ্রলোকেরাও ইংরেজি শিক্ষার ফলে নানাভাবে উপকৃত হবেন। (সিলেকশনস ফ্রম আনপাবলিশড রেকর্ডস অফ দি গভর্ণমেন্ট, রেভারেণ্ড জেমস লঙ, পৃ: ৪৮-৪৯) এটা থেকে পরবর্তীকালে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারে প্রাথমিক ভাবনার একটা আভাস পাওয়া যায়। আঠারো শতকেই মিশনারী কিয়েরনানভার, এবং তাঁর সহযোগী সিলভেষ্টার বাঙালীদের ইংরেজি শিক্ষাদানের জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন। ১৭৫৮ খৃষ্টাব্দে তাঁর স্কুলে ১৭৫ জন ছাত্র ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৭৮ জন ‘সোসাইটি ফর দি প্রমোশন অব খৃষ্টান নলেজ’-এর অর্থে শিক্ষা পেতেন। সিলভেষ্টার সেই সময়ে খৃষ্টধর্মের প্রশ্নোত্তরমূলক প্রচার পুস্তিকা ও প্রার্থনা বই বাংলা ভাষায় অনুবাদের একটা চেষ্টা করেছিলেন। (ক্যালকাটা ইন দি ওল্ডেন টাইম, রেভারেণ্ড জেমস লঙ লিখিত প্রবন্ধ) কিন্তু খৃষ্টান মিশনারী ও ধর্মযাজকদের আগ্রহ সত্ত্বেও ইতিহাস থেকে সে যুগের বঙ্গদেশের মানুষের মধ্যে ইংরেজি বা অন্য কোন ইউরোপীয় ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখবার কোন আগ্রহ দেখতে পাওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে এডওয়ার্ড ইভস লিখেছিলেন, “যদিও বালকদের শিক্ষার জন্য অনেক স্কুল আছে তবুও তাঁরা মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা শেখে না। বঙ্গদেশে অনেক ইংরেজ থাকেন, এবং দুই গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিনিয়ত আদান প্রদান ও মেলামেশা আছে; তবুও আশ্চর্যের বিষয় হল যে, ইংরেজিতে তাঁদের আলাপ করবার ক্ষমতা মাদাগাস্কারের সমুদ্র বন্দরগুলির লোকদের মত ভাল নয়।” (ভয়েজ, এডওয়ার্ড ইভস, পৃ- ২৯)
©️রানা©️
(তথ্যসহায়ক গ্রন্থাবলী:
১- বর্ধমান ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ার, জে. সি. কে. পিটারসন, ১৯১০ সাল।
২- রিয়াজ-উস-সালাতীন, গোলাম হোসেন সলিম।
৩- সিয়ার-উল-মুতাক্ষরীণ, সৈয়দ গোলাম হোসেন, দ্বিতীয় খণ্ড।
৪- হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল, যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, দ্বিতীয় খণ্ড।
৫- ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত, কার্তিকেয়চন্দ্র রায়।
৬- হিস্ট্রি অফ বিষ্ণুপুররাজ, এ. পি. মল্লিক।
৭- স্কেচেস অব দি হিন্দুস, ব্রুফার্ড, দ্বিতীয় খণ্ড।
৮- হিস্ট্রি অফ হিন্দুস, ওয়ার্ড, প্রথম খণ্ড।
৯- টিপিক্যাল সিলেকশনস ফ্রম ওল্ড বেঙ্গলি লিটারেচার, দীনেশচন্দ্র সেন, দ্বিতীয় খণ্ড।
১০- রামপ্রসাদ সেন গ্রন্থাবলী, বিদ্যাসুন্দর, বসুমতী সংস্করণ।
১১- বৃহৎ বঙ্গ, দীনেশচন্দ্র সেন, দ্বিতীয় খণ্ড।
১২- বেগমস অব বেঙ্গল, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৩- রিফ্লেকশনস, ল্যুক স্ক্র্যাফটন।
১৪- দি ট্রানজিশন ইন বেঙ্গল, আবদুল মজিদ খাঁ।
১৫- ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত, কার্তিকেয়চন্দ্র রায়।
১৬- ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলী, অন্নদামঙ্গল, মানসিংহ, বসুমতী সংস্করণ।
১৭- সিলেকশনস ফ্রম আনপাবলিশড রেকর্ডস অফ দি গভর্ণমেন্ট, রেভারেণ্ড জেমস লঙ।
১৮- ক্যালকাটা ইন দি ওল্ডেন টাইম, রেভারেণ্ড জেমস লঙ লিখিত প্রবন্ধ।
১৯- ভয়েজ, এডওয়ার্ড ইভস।)
©️রানা চক্রবর্তী©️